ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর ২০৫৪ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্থানীয় তামাক পাতা সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় ৭৪৫ কোটি টাকার, যা বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে। কিন্তু মূসক রিটার্নে দেখিয়েছে প্রায় ৫৫৪ কোটি। প্রায় ১৯১ কোটি টাকার তামাক পাতা কম দেখানো হয়েছে। এই তামাক পাতা দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৮১১ কোটি সিগারেট নি¤œস্তরের যেমন ডারবি ও পাইলট সিগারেট তৈরি হয়েছে। এই সিগারেট বিক্রির ওপর প্রায় দুই হাজার ৫৪ কোটি টাকার মূসক ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবি)। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র এক বছরে এই ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৮ সালের এক তদন্তে এই ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়। এরপর দুটি তদন্ত কমিটির দ্বিধাবিভক্ত মতামতের পর ২০২১ সালে অব্যাহতি পেয়ে যায় বিএটিবি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। অব্যাহতির আদেশ বাতিল করে দিয়েছে এনবিআর। সম্প্রতি এনবিআর গঠিত কমিটি পর্যালোচনা শেষে সে সময়ের এলটিইউর কমিশনারের দেয়া আদেশ বাতিল করা হয়েছে। সঙ্গে কমিটির পর্যালোচনায় এই রাজস্ব ফাঁকির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব অনিয়ম উঠে এসেছে। এই রাজস্ব আদায়ে এলটিইউকে নির্দেশ দেয়ার পর সম্প্রতি এলটিইউ ফাঁকি দেয়া এই রাজস্ব আদায়ে বিএটিবিকে নোটিশ জারি করেছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, বকেয়া এই রাজস্ব আদায়ে বৃহৎ করদাতা ইউনিট, মূসক থেকে নোটিশ জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি বিএটিকে দেয়া এই নোটিশে বলা হয়েছে, বিএটিবির মূসক ফাঁকির তদন্ত করতে এলটিইউকে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল চিঠি দেয় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি পর্যালোচনা করে দেখতে পান, বিএটিবির ২০১৬ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে ৭৪৫ কোটি ৩২ লাখ ৩৪ হাজার টাকার স্থানীয় তামাক পাতার ব্যবহার দেখিয়েছে। কিন্তু এলটিইউতে দাখিল করা মূসক রিটার্নে স্থানীয় তামাক পাতার ব্যবহার দেখিয়েছে ৫৫৪ কোটি ১২ লাখ ১৮ হাজার ৬৭৮ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অপেক্ষা রিটার্নে স্থানীয় তামাক পাতার ব্যবহার ১৯১ কোটি ২০ লাখ ১৫ হাজার ৩২১ টাকা কম দেখানো হয়েছে। স্থানীয় তামাক পাতা বিএটির লো সেগমেন্ট বা নি¤œস্তরের সিগারেট উৎপাদনে ব্যবহƒত হয়। প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা মূসক-১ অনুযায়ী, প্রতি শলাকা নি¤œস্তরের সিগারেট যেমন ডারবি ও পাইলট সিগারেট উৎপাদনে শূন্য দশমিক ১০৫৫৪ টাকার স্থানীয় তামাক ব্যবহƒত হয়। সে হিসেবে অতিরিক্ত ব্যবহƒত ১৯১ কোটি ২০ লাখ ১৫ হাজার ৩২১ টাকার তামাক দ্বারা ১ হাজার ৮১১ কোটি ৬৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৬২ শলাকা নি¤œস্তরের  সিগারেট উৎপাদন ও বিক্রি করা হয়েছে; যা বিএটি মূসক রিটার্নে প্রদর্শন করেনি। নি¤œস্তরের সিগারেটের প্রতি শলাকার তৎকালীন মূল্য ১ টাকা ৮০ পয়সা (মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য) হিসেবে ১ হাজার ৮১১ কোটি ৬৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৬২ শলাকার মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৬০ কোটি ৯৬ লাখ ৯৮ হাজার ৪৯১ টাকা। যার ওপর ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য মূসক ৪৮৯ কোটি ১৪ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭৪ টাকা ও ৪৮ শতাংশ সম্পূরক বাবদ এক হাজার ৫৬৫ কোটি ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ২৭৬ টাকা। সে হিসেবে মোট রাজস্ব দাঁড়ায় দুই হাজার ৫৪ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ৪৯ টাকা। বিএটি প্রযোজ্য এই রাজস্ব রিটার্নে প্রদর্শন না করে পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে।

আরও বলা হয়েছে, ফাঁকি দেয়া এই রাজস্ব আদায়ে ২০১৮ সালের ২৭ জুন এলটিইউকে নির্দেশ দেয় এনবিআর। নির্দেশ অনুযায়ী ২০২০ সালের ২৩ মার্চ মূসক আইন, ১৯৯১-এর ৫৫(১) দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো জারি করে এলটিইউ। আবার ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট ধারা ৫৫(৩)-এর মাধ্যমে বিএটিকে এই দাবিনামা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পরে অব্যাহতি প্রদানের আদেশের বৈধতা বা ন্যায্যতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হওয়ার উদ্দেশ্যে নথি পর্যালোচনার জন্য এনবিআর চলতি বছরের ১০ আগস্ট নথি তলব করে নেয়। নথি পর্যালোচনা করে এনবিআর ২১ সেপ্টেম্বর আদেশ প্রদান করে। যাতে বলা হয়, ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট জারি ‘এলটিইউ কমিশনারের জারি করা আদেশটির প্রেক্ষাপট মূসক আইন, ১৯৯১-এর ৪৩ ধারার ক্ষমতাবলে বাতিল করা হলো। ফাঁকি দেয়া রাজস্ব হিসেবে ২ হাজার ৫৪ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ৪৯ টাকা আদায়ের প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা নির্দেশ দেয়া হলো।’

নোটিশে আরও বলা হয়েছে, এনবিআরের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিএটির ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রদর্শিত অথচ রিটার্নে অপ্রদর্শিত ১৯১ কোটি ২০ লাখ ১৫ হাজার ৩২১ টাকার স্থানীয় তামাক পাতা ব্যবহার করে উৎপাদিত সিগারেট বিক্রয়ের মাধ্যমে ফাঁকি দেয়া ২ হাজার ৫৪ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ৪৯ টাকা ১৫ দিনের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায়ে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

অপরদিকে, ২১ সেপ্টেম্বর এনবিআর এলটিইউর সেই চূড়ান্ত দাবিনামার আদেশ বাতিল করে। ওইদিন এনবিআর এলটিইউকে চিঠি দেয়। যাতে ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেয়। চিঠিতে বলা হয়, এলটিইউ বিএটিকে দেয়া চূড়ান্ত দাবিনামা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষণের জন্য সদস্য (মূসক নিরীক্ষা) ড. মো. সহিদুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি যাবতীয় কাগজপত্র যাচাই ও বিশ্লেষণ করেন। কমিটি বিচারাদেশ দেয়া সেই সময়ের এলটিইউ কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীকে শুনানি করেন। কমিশনার শুনানিতে অংশ নিয়ে লিখিত বক্তব্য দেন। যাতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘এলটিইউর নথিতে সকল দলিল ও তথ্য সংযুক্ত আছে। কমিটি সেগুলো যাচাই করে নিতে পারেন। মামলাটি আইনানুগভাবে বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে যথাযথভাবে ধারা ৫৫(৩) অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা হয়েছে।’

অপরদিকে, শুনানিতে বিএটির প্রতিনিধিকে ডাকা হলেও তারা প্রথমে শুনানিতে অংশ নেবেন বলে জানান। পরে কোম্পানির কেউ শুনানিতে অংশ নেয়নি। কমিটি প্রথম তদন্ত কমিটির সব সদস্যের শুনানি গ্রহণ করেন। সদস্যরা মতামত দেন যে, লোকাল লিফ কনজামশনের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সে অনুযায়ী প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। তবে কমিটিতে কোনো বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতির কারণে কোনো ধরনের জটিলতা কমিটির কাছে অনুভূত হয়নি। কমিটি নি¤œস্তরের সিগারেট হিসেবে ডারবি ও পাইলটের কর কাঠামো অনুযায়ী অপরিশোধিত রাজস্ব আদায়ের সুপারিশ করেন। আবার দুই কমিটি কিছু ক্ষেত্রে দ্বিধা বিভক্ত মত দেয়। এনবিআর ও এলটিইউ’র গঠিত উভয় কমিটিতে এনবিআরের দু’জন কর্মকর্তা উভয়ই তদন্ত কমিটি দাখিল করা প্রতিবেদনের ওপর মতামত দেয়। তবে সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে এনবিআর গঠিত কমিটি মনে করেন, ৫৫(১) ও ৫৫(৩) জারির ক্ষেত্রে এনবিআরের নির্দেশনা, নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও আইনি পদক্ষেপ, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে দাবিনামা নিষ্পত্তি করা হয়নি।

চিঠিতে বলা হয়, এনবিআর গঠিত প্রথম কমিটি ও এলটিইউ গঠিত দ্বিতীয় কমিটির উভয়ের সদস্য ছিলেন তৎকালীন উপ-কমিশনার মো. তারেক হাসান (বর্তমানে যুগ্ম কমিশনার) ও সহকারী কমিশনার সানজিদা খানম (বর্তমানে উপ-কমিশনার)। কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদনে তারেক হাসান বিএটিবির কাছে দাবি করা রাজস্ব ফাঁকি প্রদান যথাযথ বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু সানজিদা খানম লোকাল লিফ সংগ্রহের ওভারহেড কস্ট বিবেচনায় বিএটিবির নি¤œস্তর হতে উন্নীত মধ্যম অথা উচ্চস্তরের সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিহারের সম্ভাবনা যাচাই করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। একইসঙ্গে কুষ্টিয়ায় অবস্থিত জিএলটিপির (গ্রিন লিফ টোব্যাকো প্রসেসিং) কারখানায় উৎপাদিক পণ্যের তামাকের জন্য পৃথক মূল্য ঘোষণা মূসক-১ যাচাই করা হলে তাতে লোকাল লিফ কস্টের সঙ্গে লোকাল লিফ সংগ্রহের ওভারহেড কস্টসহ অন্যান্য সকল মূল্য সংযোজনের খাতসমূহ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলে বার্ষিক প্রতিবেদনের সাথে পার্থক্য তৈরি হবে না মর্মে মত দেন। বর্তমান কমিটি সব পর্যালোচনা করে মূসক আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৪৩ বলে এলটিইউ’র ৫৫(৩) দাবিনামা বাতিল করে দেয়। ফাঁকি দেয়া এই রাজস্ব আদায়ে এলটিইউকে নির্দেশ দেয়া হয়।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনিমের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।

এই বিষয়ে এলটিইউ’র যুগ্ম কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এই বিষয়ে এলটিইউর পক্ষ থেকে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বিএটির পক্ষ থেকে এখনও কোনো জবাব আমরা পাইনি।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০