রোহান রাজিব: দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে। তবু রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি থামছে না। আমদানি দায় মেটাতে চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম তিন মাস আট দিনে রিজার্ভ থেকে ৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে গ্রস আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কমে হয়েছে ২১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে রিজার্ভ কমে ২৬ দশমকি ৮৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মূলত জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানির জন্য এই ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সংকটের কারণে বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারছে না। তাই সরকারের আমদানির জন্য রিজার্ভ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
জানা যায়, গত অর্থবছরের ১২ মাসে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। এতে ২৭ মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রিতে রিজার্ভের পতন হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমকি ৮৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ ২৭ মাসে রিজার্ভ কমেছে সাড়ে ১৯ বিলিয়ন ডলার।
দেশে দেড় বছর ধরে চলছে ডলারের সংকট। নানা পদক্ষেপের পরও সংকট কাটেনি। চলতি অর্থবছরের শুরুটা ভালো হয়নি। যে ডলার সংকট নিয়ে অর্থনীতির খারাপ অবস্থা শুরু হলো, সেই ডলার সংকট কাটেনি; বরং ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন খাতে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রায় প্রতিটি সূচকে পতন হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি, প্রবাসী আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খেলাপি ঋণ, রপ্তানি ও রাজস্বÑকোনো সূচকের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এখন হুমকিতে।
এদিকে দেশের অর্থনীতির বড় শক্তি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। সেই প্রবাসী আয়েও নেতিবাচক প্রভাব। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের প্রতি মাসে ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় কমেছে। গত জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগস্টে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১৬০ কোটি ডলারে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে আসে ১৩৪ কোটি ডলার; যা গত ৪১ মাসের মধ্যে এক মাসে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয়। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিলে ১০৯ কোটি ডলার এসেছিল।
এছাড়া রপ্তানি আয়ে খুব বেশি সুখবর নেই। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরÑপ্রতি মাসেই প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা আশা জাগাতে পারছে না। কারণ শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানি পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য চারটির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে সর্বশেষ গত মাসে। আবার মাসের হিসাবেও রপ্তানি আয়ের চিত্র ওঠানামা করছে। গত জুলাইয়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ডলার। পরে তা বেড়ে হয় ৪৭৮ কোটি ডলার। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে তা আবার ৪৩১ কোটি ডলার হয়।
জানা যায়, ডলার-সংকট ও আমদানিতে নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকে এখন ঋণপত্র (এলসি) খোলা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে ঋণপত্র খোলা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম। গত সেপ্টেম্বরে ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। আর চলতি বছরের আগস্টে খোলা হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। এর আগে গত ২০২০ সালের অক্টোবরে এর চেয়ে কম এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। আর চলতি বছরের আগস্টের তুলনায় গত মাসে এলসি নিষ্পত্তি ১৬ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে।
এমন পরিস্থিতি বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা যায়, রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার নগদায়নে কালক্ষেপণ করছে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও অসহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ডলারের সরবরাহে বিঘিœত হচ্ছে। এ অবস্থায় ইআরকিউ হিসাবে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার ৫০ শতাংশ অনতিবিলম্বে নগদায়নের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ইআরকিউ হিসাবে রাখা বৈদেশিক মুদ্রার অর্ধেকই নগদায়ন করে ফেলতে হবে ব্যবসায়ীদের। গত রোববার এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বৈদেশিক লেনদেনে নিয়োজিত অথরাইজড ডিলার ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। নতুন নির্দেশনার ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে বলে আশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের ওই চিঠিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইআরকিউ হিসাবের যে স্থিতি ছিল তার ৫০ শতাংশ সংরক্ষণপূর্বক বাকি অংশ নগদায়নের নির্দেশ দেয়া হয়। অনতিবিলম্বে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। সূত্রমতে, ওই তারিখে ইআরকিউ হিসাবে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি স্থিতি ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ভবিষ্যতে ডলারের রেট বৃদ্ধির আশায় রপ্তানিকারকদের কেউ কেউ এই সুযোগ নিতে পারেন। তবে বেশিরভাগই রাখে তার আমদানির দায় মেটানোর জন্য। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নিজেরা ব্যবসা করার জন্যও এই ডলার নগদায়নে ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা করে। ভবিষ্যতে ডলার নাও পেতে পারেন বা এখন ডলার ধরে রাখলে সামনে দাম বেশি পাবেনÑএমন যুক্তি রপ্তানিকারদের সামনে তুলে ধরা হয়। কারণ তারা জানে সব রপ্তানিকারক এক দিনেই ইআরকিউর ডলার নগদায়ন করতে আসবে না।