বীর সাহাবী: দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি সংকটও রয়েছে। বিশ্ববাজারেও চলছে নানা অস্থিরতা, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের গরম মসলার প্রায় শতভাগ চাহিদা পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। বর্তমানে গরম মসলা এবং ড্রাই ফ্রুটসের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (শুল্কায়নযোগ্য মূল্য) এবং শুল্ক হার বেড়ে যাওয়ায় বাজারে তার প্রভাব পড়েছে ব্যাপক। গরম মসলার পাশাপাশি শুকনো ফলের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে আমদানি কমেছে আর বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে ব্যাপকভাবে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগে প্রতি টন জিরা আমদানি করতে লাগত এক হাজার ৮৫০ ডলার, যার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫০০ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি টন জিরা ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৫৫৯ টাকা (প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ধরে)। প্রতি টন জিরায় এক হাজার ৬৫০ ডলার বাড়তি দিতে হচ্ছে। এতে প্রতি টন জিরা আমদানিতে ১ লাখ ৫ হাজার ৩৯৩ টাকা বাড়তি চলে যাচ্ছে আমদানিকারকদের। যার প্রভাবে দেশে জিরার দাম বেড়ে হয়েছে নাগালের বাইরে।
একইভাবে এক টন দারচিনির আগে আমদানি অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল এক হাজার ডলার; যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৫০ ডলারে। এতে আগে এক টন দারচিনি আমদানি করতে যেখানে শুল্কসহ ব্যয় ছিল ৬৩ হাজার ৮৭৪ টাকা, তা বর্তমানে ৪৭ হাজার ৯০৬ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৭৮০ টাকায়। এতে করে দারচিনির খুচরা বাজারে দামের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যের কারণে আমদানিও কমেছে। একইভাবে কিশমিশে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ৫৩ হাজার ৫২ টাকা, কাঠবাদামে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৯ হাজার টাকা, চীনা বাদামে ৪০ হাজার ৮৭৫ টাকা এবং আলুবোখারায় ৪৩ হাজার ৬০০ টাকা।
সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে খেজুরের। আগে এক টন খেজুর আমদানির অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল এক হাজার ডলার; যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ডলারে। এর পাশাপাশি শুল্কও বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে ১০ শতাংশ শুল্ক ছিল, যা বর্তমানে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৯ শতাংশ। এতে প্রতি টন খেজুর আমদানি করতে আমদানিকারকদের ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৬২০ টাকা। একই পরিমাণ খেজুর আগে আমদানি করতে ব্যয় হতো ১০ হাজার ৯০০ টাকা। এতে বর্তমানে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৭২০ টাকা। এই দুই মিলে খেজুরের দাম বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী।
আগে এক টন পেস্তার আমদানি অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল এক হাজার ৮৫০ ডলার, যা এখন ছয় হাজার ১৫০ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ডলারে; যা রীতিমতো বাজারে অস্বস্তি তৈরি করেছে। এতে আগে ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ শুল্কসহ এক টন পেস্তার আমদানি মূল্য যেখানে ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ১৬৭ টাকা, যা অস্বাভাবিকভাবে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৮২৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১০ হাজার ৯৯২ টাকায়।
পেস্তার পাশাপাশি কাজুবাদামের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ও শুল্ক দুটোই বেড়েছে। প্রতি টন কাজুবাদাম আমদানিতে আগের ভ্যালু ছিল এক হাজার ৮৫০ ডলার। বর্তমানে তা চার হাজার ১৫০ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ডলারে। অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুর পাশাপাশি কাজুবাদাম আমদানির শুল্কও বেড়েছে। ৩১ শতাংশ শুল্ক থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। এই দুই বেড়ে কাজুবাদামের দামের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে এক টন কাজুবাদাম আমদানি করতে আমদানিকারকদের গুনতে হচ্ছে ২ লাখ ৮১ হাজার ২২০ টাকা। এই দাম আগে ছিল মাত্র ৬২ হাজার ৫১১ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানে এক টন কাজুবাদাম আমদানি করতে ২ লাখ ১৮ হাজার ৭০৮ টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে।
শুল্কায়নযোগ্য মূল্য এবং শুল্কহার বাড়ার ফলে গরম মসলা এবং শুকনো ফলের আমদানি চাহিদা অনুযায়ী কমেছে। ফলে দেশের বাজারে তৈরি হয়েছে গরম মসলা এবং শুকনো ফলের সরবরাহ সংকট। আর এর প্রভাব পড়েছে দামে। দেশের বাজারে দফায় দফায় কয়েকগুণ বেড়েছে গরম মসলা এবং শুকনো ফলের দাম।
এসব কারণে গরম মসলা শুকনো ফলের বিভিন্ন চালান চোরাকারবারিদের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করছে। গরম মসলা ও শুকনো ফলের বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রকৃত আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বলে গত বুধবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) কাছে এক আবেদনে দাবি করেছে বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতি। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এফবিসিসিআই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করেছে।
এর আগে ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতি এফবিসিসিআইর কাছে করা চিঠিতে বলেছে, সমিতির তালিকাভুক্ত সব পর্যায়ের গরম মসলা এবং ড্রাই ফ্রুটস আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে।
মসলা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জের এবি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশ গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অমর কান্তি দাস শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ডলারের দাম বাড়ায় মসলার দাম বেড়েছে। বর্ডারগুলো দিয়ে বেড়েছে অবৈধভাবে পণ্য চোরাচালান। এতে আমরা যারা বৈধভাবে ব্যবসা করি; তাদের ওপর প্রভাব পড়ছে। এছাড়া মসলাজাতীয় পণ্য আমদানি করতে গিয়ে এখন নানা রকম জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। বর্তমানে এলসি জটিলতা প্রকট।’
তিনি বলেন, ‘সরকার সব মিলিয়ে ৬৩ শতাংশ শুল্ক আদায় করে মসলা আমদানিতে। আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে অনুরোধ করেছি শুল্ক কমানোর জন্য। আমাদের দাবিগুলো মানা হলে গরম মসলার বাজার কিছুটা ঠান্ডা হবে। কোনো পক্ষ একা লাভবান হবেন, এমনটা হতে পারে না। আমরা চাই সরকারও বাঁচুক, আমরাও বাঁচি।’
বছরে আমদানি ব্যয় ৯০০ কোটি টাকা: দেশে তিনটি সমুদ্রবন্দর থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় মসলা। তিন শতাধিক আমদানিকারক প্রতি বছর প্রায় ৯০০ কোটি টাকার মসলা আনছেন দেশে। টেকনাফ, বেনাপোলসহ কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়েও আসছে মসলাজাতীয় পণ্য। দেশে প্রতি বছর শতকোটি টাকার রসুন আসে। এগুলো আমদানি করে ৭০ থেকে ৮০টি প্রতিষ্ঠান। ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার এলাচ আসে প্রতি বছর। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আসে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার। তবে আমদানি বহাল থাকলে স্থলবন্দর দিয়ে আসে ২০০ কোটি টাকারও বেশি পেঁয়াজ। দারচিনি, লবঙ্গ, হলুদ, মরিচ, জয়ত্রীসহ সব ধরনের মসলা মিলে আমদানি ছাড়িয়ে যায় ৯০০ কোটি টাকার ঘর।
প্রতি বছর ঈদুল আজহা ঘিরে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, জিরা, হলুদ, মরিচ, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, জয়ত্রীসহ মসলাজাতীয় সব পণ্যের চাহিদা বাড়ে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দামও। প্রায় সবগুলো পণ্যের দামই বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। বাজারে এসব পণ্য কিনতে অস্বস্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। ডলার, এলসি সংকটের পাশাপাশি পাইকারি ব্যবসায়ীদের রয়েছে সিন্ডিকেট। খুচরায় লাগামহীন দাম রাখলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ভুগতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ আগে পাইকারি দরে কেজিপ্রতি জিরা বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৬০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। তবে বর্তমানে পণ্যটির বিক্রয় মূল্য কমতে শুরু করেছে। এখন জিরা এক হাজার ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে কেজিতে ৪০-৬০ টাকা দাম কমেছে মসলাপণ্যটির।
অন্যদিকে, কেজিপ্রতি এলাচের দাম ১০০-২০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ২০০ টাকায়, প্রতি কেজি লবঙ্গ ১০০ টাকা কমে ১ হাজার ২৬০ টাকায়, গোলমরিচ ১০-১৫ টাকা কমে ৬০৫ টাকায়, জায়ফল ২০-৩০ টাকা কমে ৬৫০-৬৬০ টাকায়, জয়ত্রী ৭০-৮০ টাকা কমে ২ হাজার ৫৫০ টাকায়, মিষ্টি জিরা ৪০ টাকা কমে ২৭০ টাকায়, আস্ত শুকনো মরিচ (ভারতীয়) ৩০-৪০ টাকা কমে ৩৭০ টাকায় এবং দেশীয় মরিচ ২২-২৩ টাকা কমে কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৬৭-২৬৮ টাকায়। শুকনো আস্ত হলুদ ১০ টাকা কমে প্রতি কেজি ১৭৫ টাকায়, কালোজিরা (ভারতীয়) ৬০ টাকা কমে ২৪০ টাকায়, কালোজিরা (দেশীয়) ৪০ টাকা কমে ২৩০ টাকায়, মেথি ৫-১০ টাকা কমে ১২৫ টাকায়, তেজপাতা ১০-১৫ টাকা কমে ৮০ টাকায়, রাঁধুনি মসলা ১০ টাকা কমে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে কয়েকটি মসলাপণ্যের দাম বেড়েছে। তার মধ্যে দারচিনির দাম কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বেড়ে ৩৪৫ টাকা, আস্ত ধনিয়া ১০-১৫ টাকা বেড়ে ১৮০-১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে আমদানি সংকট ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় ছয় মাস ধরে দেশের মসলার বাজার অস্থির। বিশেষত কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মসলার বাজার সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, এলসি খুলতে জটিলতার কারণে আমদানি কমে যায়। আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারেও মসলার দাম বেড়ে যায়।
শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী নিজাম ব্যাপারী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আগামী কয়েক মাস গরম মসলার চাহিদা কম থাকবে। এ কারণে পাইকারি বাজারে ধীরে ধীরে দামও স্থিতিশীলতার দিকে ফিরছে।’
কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মসলার বাজারের বৃহৎ অংশই মূলত আমদানিনির্ভর। দেশের বাজারে সবচেয়ে বেশি মসলা আসে ভারত ও চীন থেকে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার, গুয়েতেমালা, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মসলা আমদানি করে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণভাবে শুধু ধনিয়া, মিষ্টি জিরা, মরিচ, হলুদ, তেজপাতা, কালোজিরাসহ হাতেগোনা কয়েকটি মসলা উৎপাদন হয়। তবে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় এসব পণ্যেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমদানি করতে হয়।