উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ক্যাশলেস লেনদেনে ক্রেডিট কার্ডই ভরসা!

রেজাউল করিম খোকন: এখন কেনাকাটায় ক্যাশলেস লেনদেনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। তাই গ্রাহকদের কেনাকাটাকে আরও সহজ ও নিরাপদ করতে ব্যাংকগুলোও দিচ্ছে কার্ডনির্ভর লেনদেনে নানা অফার বা সুবিধা। ফলে নগদ টাকা ব্যবহারের ঝক্কি দূর হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রাহকরাও পাচ্ছেন সাশ্রয়ে কেনাকাটার সুযোগ। ব্যাংকগুলোও গ্রাহকদের জন্য কার্ডে কেনাকাটায় নানা ছাড় দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের কাছে খুদেবার্তা ও ই-মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন অফারের তথ্য জানানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন দোকানের ক্যাশ কাউন্টারেও ঝুলছে এ-সংক্রান্ত প্রচারণা। ফলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্রাহকও যুক্ত হচ্ছেন ক্রেডিট কার্ড-ডেবিট কার্ডের সঙ্গে। এখন মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত নগদ টাকা নিয়ে চলাফেরা করতে চান না। কার্ডের সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধার গুরুত্ব নিয়ে আগামীর ক্যাশলেস বাংলাদেশ তৈরিতে ব্যাংকের কার্ড সেবায় ডিজিটাল লেনদেনকে গুরুত্ব দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর অংশীদারিত্ব বাড়ছে। গ্রাহকরা কার্ডে লেনদেন করার মাধ্যমে ব্যাংক এবং লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান-উভয়ের সুযোগ-সুবিধা একসঙ্গে পাচ্ছে। গ্রাহকদের জন্য এমনিতেই বছরজুড়ে বিভিন্ন অফার দিয়ে থাকে ব্যাংক। শুধু সুযোগ-সুবিধা নয়, কার্ডের নিরাপত্তার বিষয়টিকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন গ্রাহকরা। কার্ডনির্ভর লেনদেন নিরাপদ করতে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা যে কোনো নিরাপত্তার কারণে তাদের কার্ড ব্লক করতে পারেন, লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য দেখতে পারেন, ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি) চ্যানেলের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো ব্যাংকে টাকা পাঠানো ও গ্রহণ করতে পারেন। এ ছাড়া পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স ছাড়া বাকি সব সেবা ঘরে বসে অনলাইনেই নিতে পারেন গ্রাহকেরা; যা কার্ডনির্ভর লেনদেনকে ত্বরান্বিত করছে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্যাশলেস আগামীর বাংলাদেশ তৈরি করতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোর এসব আকর্ষণীয় সুবিধা ও ছাড় গ্রাহকদের কার্ড ব্যবহারে উৎসাহী করছে। নগদ অর্থ বহনের ঝামেলা নেই আর পর্যাপ্ত টাকা হাতে না থাকলেও পরে দেয়ার সুবিধার কারণেই অনেকেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন, যদিও এর ইন্টারেস্ট রেট অনেক বেশি, আধুনিক বিশ্বে ক্রেডিট কার্ডকে বলা হয় প্লাস্টিক মানি। এক কথায় এটি একটি কার্ড যা ব্যাংক বা এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে একজন গ্রাহক নিতে পারে। এর বৈশিষ্ট্য হলো হাতে নগদ টাকা না থাকলেও এই কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করা যায়। তবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত অর্থ ব্যবহার বা খরচ করা বা উত্তোলন করতে পারেন একজন গ্রাহক তার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। নির্দিষ্ট সময় পর তার ওই টাকা পরিশোধ করতে হয়। আবার ক্রেডিট লিমিট বা কত টাকা পর্যন্ত খরচ বা উত্তোলন করা যাবে সেটি সাধারণত ব্যাংকগুলো হিসাব করে গ্রাহকের মাসিক আয়ের ভিত্তিতে। তবে ব্যাংকগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নীতি থাকার কারণে ক্রেডিট লিমিট সব ব্যাংকের একই নাও হতে পারে। একজন গ্রাহক চাইলে তার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে বাড়ির ইউটিলিটি বিল, ইন্টারনেট বিল এমনকি ড্রাইভারের বেতন পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে পরিশোধ করতে পারেন। ক্রেডিট কার্ড এখন আর বিলাসী কোনো ব্যাপার না, এটি এখন বহু মানুষের নিত্যব্যবহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও আগামী এক দশকে ব্যাপক প্রসার হবে ক্রেডিট কার্ডের। সরকারি-বেসরকারি সব সেবা ডিজিটালাইজড হয়ে যাচ্ছে যেভাবে তাতে করে সাধারণ মানুষও আগামীতে এই কার্ড ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে উঠবে। সাধারণ অনলাইনে কেনাকাটা বা সরাসরি দোকানে গিয়ে ক্রয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায় ক্রেডিট কার্ড। ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা ঘরে বসেই ই-কমার্সের মাধ্যমে যে কোনো লাইফ স্টাইল পণ্য, সিনেমার টিকিট, খাবার, বাস-রেলওয়ের টিকিট ক্রয়ের সুযোগ পান। বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা বিভিন্ন মার্চেন্ট আউটলেটে লাইফ স্টাইল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স কেনাকাটায় নানা ছাড় পেয়ে থাকেন। ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক কার্ড চেকের মাধ্যমে দরকারি সময়ে নগদ অর্থ উঠাতে পারেন। দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার হয়ে থাকে ২৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর সিংহভাগই খরচ হয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা সুপারশপে। খুচরা আউটলেটে ব্যবহার হয় ১৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। বিদেশে কেনাকাটায় বেশি ব্যবহার হয় ভিসা কার্ডের মাধ্যমে, যা প্রায় মোট লেনদেনের ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ, মাস্টার কার্ডের মাধ্যমে খরচ হয় ১৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, এমএক্স কার্ডের মাধ্যমে খরচ হয় ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ডে মাধ্যমে ভারতে ব্যবহার হয়ে থাকে ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার হয় ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ব্যবহার হয় ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ব্যবহার হয় ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ, কানাডায় ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ, আরব আমিরাতে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, সৌদি আরবে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ ব্যবহার হয়। আগস্ট মাসে বিদেশি নাগরিকরা দেশের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ করেছেন ২১৮ কোটি টাকা। এসব নাগরিকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের নাগরিক ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ভারতের নাগরিক ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের নাগরিক ৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ ক্রেডিট কার্ডে মাধ্যমে খরচ করেছেন।

বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস অবস্থা সাধারণ মানুষের। আয় তেমন না বাড়লেও খরচ বেড়েছে অধিকাংশের। অনেকেই ধারদেনা করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন অনেকে। এ অবস্থায় সুপারশপগুলোয় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বাড়ছে। মূলত এখানে কেনাকাটায় ৪৫ দিনের জন্য ঋণ পরিশোধের সুযোগ পান গ্রাহক। কেনাকাটাও ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকে। এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছেন গ্রাহক। গত আগস্টে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা; যা আগের মাস জুলাইয়ে ছিল ২ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ৯৬ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আগস্ট মাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সুপারশপে এক হাজার ২১৮ কোটি টাকা কেনাকাটা হয়েছে, যা মোট লেনদেনের ৪৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অন্যদিকে জুলাই মাসে সুপারশপে কেনাকাটায় লেনদেন হয়েছে এক হাজার ১৭৩ কোটি টাকা বা মোট লেনদেনে ৫০ দশমিক ১১ শতাংশ। তথ্য মতে, শতকরা হিসাবে আগস্টে লেনদেন কমলেও টাকার পরিমাণে লেনদেন বেড়েছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর খরচের ধরন বিবেচনায় গ্রাহক খুচরায় ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ কেনাকাটা করে থাকেন। তারা ইউটিলিটির জন্য ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ লেনদেন করে থোকেন। ওষুধ কেনাকাটায় ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, পোশাকে ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, ফান্ড ট্রান্সফারে ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ, পরিবহন কাজে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ব্যবসায়িক উদ্দেশে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ, পেশা ও সরকারি সেবায় এক দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ লেনদেন হয়ে থাকে। এখন অনেকেরই আয়ের সিংহভাগই খরচ হয়ে যায় মাসের শুরুতে। মূলত দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হয়। পরে ধারদেনা করে চলা লাগে। তারা এখন তাই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। এর মাধ্যমে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে লেনদেন করছেন। আর ধার করা লাগছে না। আবার ক্রেডিট কার্ডেও ৪৫ দিনের সময় পাওয়া যায়। ব্যাংকগুলোও ক্রেডিট কার্ডের প্রচারণা করছে জোরেশোরে। নিত্যপণ্যসহ নানা পণ্য কিনতে ক্রেডিট কার্ডে ছাড় দেয়া হয়ে থাকে। গ্রাহকের সুবিধার কথা বিবেচনায় এনে নানা অফার দিয়ে প্রচার করছে তারা। গ্রাহক যাতে এসব অফার নিতে পারেন।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০