দিনু প্রামানিক: কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ। কৃষিতেই মুক্তি। দেশের টেকসই উন্নয়নে দেশে প্রয়োজন সত্যিকারের উদ্যোক্তা। দরকার সমন্বিত কৃষি উদ্যোক্তা।
কয়েক বছর আগে আমার বদলি কর্মস্থল ছিল কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সঙ্গত কারণে, সেখানকার বাজারে গিয়েছিলাম কিছু দেশি মুরগির ডিম কেনার জন্য। বাজারে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে অবশেষে ব্রিজের নিচে খোঁজ মিলল এক ডিম বিক্রেতার। হরেক সাইজ আর সাদা লাল রঙের ডিমের খাঁচা সাজিয়ে বসে আছে। খোঁজ চাইলাম, দেশি মুরগির ডিম আছে কিনা!! উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে খানিক বাদে বলল, নেই। তাহলে দেশি হাঁসের ডিম! সেটাও নেই। তার ভাষ্য মতে, গ্রামের মহিলারা এখন আর হাঁস মুরগি পালে না। একসময় গ্রাম থেকে দেশি মুরগির ডিম হাটে বিক্রি করতে আসত আর এখন গ্রামের লোকজন হাটে এসে খামারের মুরগির ডিম কিনে নিয়ে যায়। ছোট জাতের খামার মুরগির লাল ডিম বেছে বেছে দেশি মুরগির ডিম নামে বিক্রি করে আর খামার হাঁসের ডিমকে দেশি হাঁসের ডিম বলে বিক্রি করে।
একসময় হাটে বাজারে বিক্রি হতো ঢেঁকি ছাঁটা লাল চাল, খোলা লবণ, খোলা চিনি, মাটির হাঁড়ি ভরা খাঁটি আখের গুড়, গরুর খাঁটি দুধ, খোলা চানাচুর আর হরেক রকম বাহারি মিষ্টিজাত দ্রব্য। খোলা বাজারে হলেও সরিষার তেল ছিল খাঁটি। খোলা খাবারে আমাদের হাজারও পেটে পীড়া দেখা দিতে পারে। কাজেই, সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য খোলা থেকে হয়ে গেছে ভদ্র বাহারি রং- বেরঙের পোশাকে মোড়ানো। এক কথায়, প্যাকেটজাত দ্রব্য। এভাবেই পুরা বাজার এখন করপোরেটের মুঠোয়। অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এখন হাতেগোনা পাঁচ ছয়টা করপোরেট কোম্পানির হাতে। মার্জিত বাহারি মোড়কে মোড়ানো এসব পণ্য যদি খাঁটি হয় তাহলে কোনো কথা নেই। যদিও এসব পণ্যের গুণ, মান, উৎপাদন তারিখ সব প্যাকেটো গায়ে লেখা থাকে। যার কারণে ভোক্তা ক্রেতা সাধারণের মাঝে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। করপোরেট আর সিএমএসএমই সেক্টরের নিয়ে ভাবতে গেলে দেখা যায় করপোরেটের দাপটে সিএমএসএমই সেক্টরের অবস্থান খুবই সামান্যত।
সিএমএসএমই সেক্টরের চানাচুর উৎপাদনকারী বলে, আমার চানাচুর খোলা বাজারে চলে না। এক সময়ে শন-খড়ের বারুন (ঝাড়ু) তৈরি এক এক বাড়ি যেন এক এক পল্লিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। তৈরি হতো রং-বেরঙের হরেক রকমের তাল পাতার পাখা। কোন কোন এলাকার বাড়ি, উঠান, রাস্তার পাশে, বাগান বা বড় গাছের তলায় নারী-পুরুষ একসঙ্গে মিলে এ কাজ করত। কই এখন তো এগুলো দেখা যায় না! এসব পণ্যের অনেকটাই এখন প্লাস্টিক দখল করে নিয়েছে। খোলা লবণ বিক্রি এখন আর নেই বলা চলে। আর চিনির বাজার! আমদানি না হলে তো বাজারে চিনি নেই। আখচাষি বলে, লোকসান তাই আখ চাষ করি না। চিনিকলগুলো প্রায়ই সারা বছর বন্ধ থাকে আখের অভাবে। সার কারখানাগুলো কি চালু আছে! ডাল মিল এখন ডাল আমদানি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে। দেশি গরু চাষে কৃষকের পোশায় না। আন্তর্জাতিক ডাম্পিং ব্যবসা বা অন্য কোনো কারণে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমরা দিন দিন আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি। অথচ বাড়ির আনাচে কানাচে পতিত জমিতে অথবা ফুলের টবে শখের বসেও যদি দুই চারটা মরিচ বা বেগুন গাছ লাগানো যায়, তবে চার পাঁচ-জনের পরিবারে সারা বছর আর মরিচ বেগুন কেনা লাগে না। দেশের অধিকাংশ নদীগুলো প্রায় সারা বছর অল্প পানি বা পানি শূন্য থাকে। নদীর পাড়, ঢালু বা পলি যুক্ত চরে যদি শুধু ডাল বিজ ছিটিয়ে দেয়া হয়, তাতে আমার মনে যে পরিমাণ ডাল উৎপাদন হবে তা নিজের দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশ থেকে আমদানি না করে বরং বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। আমরা জানি আমার দেশের মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি। এই মাটিতে এত সুস্বাদু পেঁয়াজ আর সবজিÑফল হয় তা পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে আমার মন হয় না। শুধু রসুন কোয়া ছিটিয়ে দিলে এত সুস্বাদু আর বড় বড় রসুন উৎপাদন হয় তা কি পৃথিবীর আর কোথাও হয়! সূর্যমুখী বীজ যদি এসব চরে শুধুই ছিটিয়ে দেয়া হয়, তাতে যে পরিমাণ তেল হবে আদৌ কি তখন তেল আমদানি করতে হবে!! হাইওয়ে বা রেলের ধারে যদি সূর্যমুখী ফুল চাষ হয়, কেমন হবে! দু’ধারে ফুলের সৌন্দর্য আর মাঝখান দিয়ে ট্রেন বা বাস চলবে। মনে হবে আমরা ফুলের দেশে আছি। দেশের সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমন ভোজ্যতেলের ঘাটতি কি কমবে না।
এর জন্য দরকার আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ। কৃষিনির্ভর দেশে কৃষক সমন্বিত পরিকল্পনা। প্রয়োজন দেশ মাতৃকার মমতা-ভালোবাসা, মহত্ত্ব, সত্যিকারের দেশপ্রেম। দরকার ভালো পৃষ্ঠপোষক, দরকার সত্যিকারের উদ্যোক্তা।
সমন্বিত পরিকল্পনা আমাদের দেশে তামাক চাষ করা হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। যেখানে সাধারণ কৃষক রবি মৌসুম ফসল থেকে সামান্যতম লাভে তামাক চাষে আগ্রহী বা বাধ্য হচ্ছে। তামাক চাষের পরিবর্তে সমন্বিত কৃষি পরিকল্পনা যদি দেশের মোট চাহিদানুযায়ী প্রত্যেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাষাবাদ করা যেত। তাহলে সাধারণ কৃষক যেমন উপকৃত হতো, দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পন্ন হতো, আমদানি নির্ভরশীল কমত, দেশের রির্জাভ আরও শক্তিশালী হতো আমার দেশ সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ হতো।
পণ্য উৎপাদন থেকে বাজারজাত করা যতটা কঠিন, সময় সাপেক্ষ এবং কম লাভ। আজকের বাজারে পণ্য আমদানি করে বাজারজাত করা মনে হয় ততটা সহজ। অল্প সময়ে বেশি পয়সা। তাইতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকটে ব্যবসায় বাবাজিরা রাতারাতি দাম বৃদ্ধি করে দেশের সরকারকে বিপদে ফেলে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার কৌশল করে। তারপর ক্ষুদ্র খামারিদের দোহায় দিয়ে সরকারের সঙ্গে বাজারমূল্য দরকষাকষিতে তাদের মূল্যটা কে জাহির করে। তবুও আমরা ভালো আছি।
দেশের পাঁচ-ছয়টা করপোরেট যদি সমগ্র দেশের নিত্যপণ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তবে এই করপোরেট কেন দেশীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে জনসাধারণকে উজ্জীবিত করে দেশের প্রতি মমতা বোধ সৃষ্টি করে এ দেশকে আমদানিনির্ভর না করে; বরং দেশের চাহিদা পূরণ করে দেশীয় পণ্যের রপ্তানিনির্ভর করে দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশে পরিণত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। দেশকে খাদ্য আমদানি-নির্ভরশীলতা থেকে বের করতে পারলে দেশের রির্জাভ বেড়ে যাবে, স্বল্পকালীনসময়ে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি কমে আসবে, দেশে কালোবাজারি কমে যাবে, সু®ু¤ ধারার বাজার ব্যবস্থা পরিচালিত হবে। এতে ব্যবসায়, উদ্যোক্তা বা করপোরেট প্রতিও দেশের গণ মানুষের শ্রদ্ধা সম্মান যেমন বহুগুণে বেড়ে যাবে, তেমন দেশের মানুষের জীবনমান বহুগুণে বেড়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। অতএব, প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন আর সত্যিকারের উদ্যোক্তা। দরকার সমন্বিত কৃষি উদ্যোক্তা। ব্যাংকার