যন্ত্রে আধুনিক মননে সেকেলে

বর্তমান সমাজে খুব প্রচলিত একটি বিষয় বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় সেটি হলো তথাকথিত সম্পর্ক। প্রেম, ভালোবাসা মানুষের জীবনে আসে, এটি স্বর্গীয় একটি বিষয় এবং পবিত্র। কিন্তু মানুষ নানাভাবে এটিকে কলুষিত করছে। আধুনিক সভ্যতায় আমরা এতটা আধুনিক হয়ে গিয়েছি যে আমাদের সবকিছু এখন যন্ত্রেই নির্ভর এবং এর ওপরই আমাদের সমস্ত ভরসা, বিশ্বাস। মানুষ ভুলে গেছে আত্মার বন্ধন ও সম্পর্ক। এখনকার সমাজে প্রেম বলতেই বোঝায় দুজন মানুষ তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাসওয়ার্ড শেয়ার করবে, ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকবে না এবং সবকিছু শেয়ার করবে। সম্পর্কে মানুষ জড়ায়, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত এতটুকু জায়গা রাখে না নিজের জন্য, পরিবার এর জন্য, বন্ধুদের জন্য। সবকিছুর একমাত্র নির্ভরতা একটা সম্পর্ক আর প্রেম। এর জন্য সবকিছুকে মনে হয় বিসর্জন দিয়ে দেবে। প্রত্যেকটা মানুষেরই যে একটা আলাদা জায়গা থাকবে, ক্ষেত্র থাকবে এবং থাকবে সীমাবদ্ধতা তা যেন লোকে ভুলেই যায়। দুজন মানুষের একজন কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশছে, কথা বলছে ইত্যাদি ছোট বিষয়েও আসে সীমাবদ্ধতা। সম্পর্ক মানেই ওই একজন মানুষকে সবসময় সময় দেয়া, কথা বলা, ফেসবুক আইডিতে নিয়মিত ঘাঁটাঘাঁটি করা ইত্যাদি এসবকিছু ভালোবাসা শব্দটিকে একেবারে গৌণ করে ফেলেছে। কবি সাহিত্যিক বা বড় বড় গুণীজন নির্দিষ্ট করে প্রেমের সংজ্ঞায়ন দিয়ে যেতে পারেননি, এটি মনের একটি বিস্তৃত বিষয়। নির্দিষ্ট যন্ত্রে এর ভিত্তি, বিশ্বাসকে ছেয়ে ফেলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। আসলে এখন মানুষ প্রেম, সম্পর্ককে সহজলভ্য করে ফেলেছে। বলাবাহুল্য নয়, আমরা আধুনিক হয়েছি যন্ত্রে, কিন্তু বিশ্বাস, ভরসা এসব শব্দ এবং এরকম বৃহৎ বিষয়কে যে এরকম ছোট কিছুর ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে নেয়া যায় না, সেই সুন্দর চিন্তায় আমরা এখনও সেকেলেই আছি।

তথাকথিত এসব সম্পর্কে সহজেই ভুল বোঝাবুঝি, অবিশ্বাস প্রতারণা ভর করে। ফলে তরুণদের মাঝে হতাশা দেখা যায়। বিধাতার দেয়া এত সুন্দর একটি জীবনকে তারা শুধু ওই একটি সম্পর্ক আর প্রেম দিয়েই বিচার করে। অথচ এই জীবনের পেছনে বাবা-মায়ের কত ত্যাগ, সাধনা, কত স্বপ্ন জড়িয়ে আছে তা মানুষ ভুলে যায়। কিছু দিনের সম্পর্কে এসব ছোট বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দেয়, ভাঙন আসে, ছেলে-মেয়েরা হতাশ হয়ে আত্মাহুতির সিদ্ধান্ত নেয়। এরকম সিদ্ধান্তের জন্য কত জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। অথচ মানুষের জীবনে ভাঙা গড়া আছে। প্রেম আসবে, যাবে, কিন্তু জীবন থেমে থাকবে না। তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে এখনও যেহেতু বেঁচে আছি তার মানে বিধাতার কোনো উদ্দেশ্য আছে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই আমাদের যেতে হবে বহুদূর। কোনো কিছুর জন্যই জীবন থেমে যায় না, শুধু সময়ের কাজটি আমাদের সময়ে করে যেতে হবে। একদিন এসব তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের বোধ আসবে। জীবনের খুব সুন্দর অর্জনের সামনে মনে হবে ওগুলো ছিল আশীর্বাদ। ভেঙে পড়ে থেমে থাকিনি সেটার জন্য মনে মনে আনন্দ আসবে।

তাই সম্পর্কে জড়ালেও নিজের ব্যক্তিগত জায়গাটি সুরক্ষিত রাখতে হবে, সবকিছুর সীমাবদ্ধতা আছে, সম্পর্কেরও থাকবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাসওয়ার্ড, একান্ত ব্যক্তিগত ছবি এবং নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পরিবার, ভাই-বোন, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন সবার জন্য জায়গা থাকবে এবং শুধু একটি মানুষের জন্য নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এককেন্দ্রিক হয়ে যাওয়া উচিত নয়। নিজের সম্ভাবনার জায়গাগুলো খুঁজতে হবে এবং সর্বোপরি আত্মোন্নয়নের দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কারণ নিজের জায়গায় নিজে প্রতিষ্ঠিত এবং নিজের গণ্ডিতে সম্ভাব্য অর্জনটি না করলে শেষ পর্যন্ত কেউ থাকে না। তাই নিজের জায়গাটি শক্ত ও মজবুত করে বাস্তববাদী হতে হবে।

ইসরাত জাহান সুমনা

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০