বিশেষ প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১০ সালের জুলাইয়ে। ট্রান্স এশিয়ান রেলরুটের অংশ হিসেবে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি বাড়াতে ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের এ প্রকল্প নেয়া হয়। তবে শুরুতেই ভুল ছিল প্রকল্প গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। কোনো ধরনের বিস্তারিত সমীক্ষা ছাড়া নেয়া এ প্রকল্পের ব্যয় সে সময় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা।
প্রকল্পটি পাস হওয়ার তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৩ সালে এটি নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল সে সময়। এজন্য ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সমীক্ষা করতে গিয়ে নানা বিষয় সামনে আসে রেলের।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, হাতি চলাচলের পথ, প্রস্তাবিত রেলরুটের জনবসতিপূর্ণ কিছু অংশে মানুষের বসতবাড়ি গড়ে ওঠা প্রভৃতি কারণে রেলপথটির অ্যালাইনমেন্টে পরিবর্তন আনতে হয়। এছাড়া মিটারগেজ থেকে রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তরের পরিকল্পনাও নেয়া হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেলপথটির বিস্তারিত সমীক্ষা ও ডিজাইনশেষে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ নির্মাণব্যয় বাড়ে প্রায় ৮৭৪ শতাংশ।
প্রকল্পটি সংশোধনের সময় দোহাজারী-কক্সবাজার অংশটি ২০১৮ সালের মধ্যে নির্মাণ শেষ করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। একনেক সভায় সে নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে দোহাজারী-কক্সবাজার অংশের জন্য দুই প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগেই লেগে যায় ২০১৭ সাল। প্রথম প্যাকেজ (দোহাজারী-চকরিয়া) যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন। আর দ্বিতীয় প্যাকেজে (চকরিয়া-রামু-কক্সবাজার) যৌথভাবে কাজ করছে চায়না সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ইন্সপেকশন কোম্পানি (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
প্রথম প্যাকেজের চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় দুই হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় প্যাকেজের প্রায় তিন হাজার ৫০২ কোটি টাকা। চুক্তির মেয়াদ ধরা ছিল তিন বছর, যদিও পরে তা বাড়ানো হয়। আর ২০১৮ সালে মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। যদিও মিয়ানমারের সম্মতি না পাওয়ায় পরবর্তীতে রামু থেকে ঘুনধুম অংশের ২৮ কিলোমিটার বাদ দিতে হয়েছে। এতে প্রকল্পটির আওতায় দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, কক্সবাজার যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার রেলপথ ব্রিটিশ আমলেই নির্মাণ করা হয়। তবে ওই রেলপথটি খুবই জীর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া কালুরঘাট সেতুটিও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এজন্য চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী রেলপথটি সংস্কার এবং কালুরঘাটে নতুন রেলসেতু নির্মাণে দুটি পৃথক প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে গতি কমিয়ে ট্রেন চালানো হবে।
যদিও এরই মধ্যে ঘটে গেছে অনাকাক্সিক্ষত এক ঘটনা। গত আগস্টে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের একটি অংশে পাথর ও মাটি ভেসে গেছে। এতে প্রায় এক কিলোমিটার রেলপথ উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। পরে ওই অংশটি সংস্কার করে রেলপথটি ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত করা হয়। যদিও আজ উদ্বোধনের পরই ট্রেন চলবে না এ রুটে। আগামী ১ ডিসেম্বর ট্রেন চলাচল শুরু হবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার। প্রাথমিকভাবে একটি ট্রেন চালু করা হবে।
এদিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কাছে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় নির্মিত হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন ছয়তলাবিশিষ্ট আইকনিক রেলস্টেশন। ২৯ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা এক লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের রেলস্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছে। আইকনিক এ রেলস্টেশনে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সুবিধা। দৈনিক ৪৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আইকনিক রেলস্টেশনে আরও আছে ডাকঘর, কনভেনশন সেন্টার, তথ্যকেন্দ্র, এটিএম বুথ ও প্রার্থনার স্থান।
আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণে খরচ হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার বিকালে রেলস্টেশনটি পরিদর্শন করেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রেল চলাচলের জন্য এ স্টেশন ও রেলপথ প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ ও রেলস্টেশন উদ্বোধনের পর অর্থনীতির নতুন দ্বার উšে§াচন হবে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্মকর্তারা বলেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছয়তলা ভবনের রেলস্টেশনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে পদচারী সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। আবার ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন পথে বেরিয়ে যাত্রীরা পা বাড়াবেন সমুদ্রসৈকতের দিকে। গমন ও বহির্গমনের জন্য তৈরি হয়েছে পৃথক দুটি সড়ক। আছে গাড়ি পার্কিংয়ের পৃথক তিনটি বড় জায়গা।
ভবনের পূর্ব পাশে নির্মিত হয়েছে ৮০ ফুট লম্বা পদচারী সেতু। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় পৃথক তিনটি চলন্ত সিঁড়ি। বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ভবনের উত্তরে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে।
মূল ভবনের নিচতলার রাখা হয়েছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কক্ষ, লকার, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী সেতুতে যাতায়াতের পথ। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে শপিংমল, শিশুযত্ন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ প্রভৃতি। তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল, চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়।
১০০ কিলোমিটারের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে আইকনিক এই রেলস্টেশন। ঢাকা থেকে রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজার নেমে পর্যটকেরা লাগেজ ও মালামাল স্টেশনে রেখে সারাদিন সমুদসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে। স্টেশন ভবনের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচতলাবিশিষ্ট ২০টি ভবন।