রহমত রহমান: ৪০ এইচসি (হাই কিউব) এফসিএল (ফুল লোড কনটেইনার)। এই কনটেইনারে একটি পোশাক প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করেছে ২৫৯ কেজি গার্মেন্টস পণ্য। আবার একই মাপের আরেক কনটেইনারে একটি পোশাক প্রতিষ্ঠান ৮৮ কেজি গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করেছে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে দুটি কনটেইনারে রপ্তানির এমন তথ্য উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অ্যাসাইকুডার তথ্যের চেয়ে দুটি কনটেইনারে কয়েকশ গুণ বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আর প্রতিটি কনটেইনারে এক প্রতিষ্ঠান নয়, একাধিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, কিন্তু এতে সব প্রতিষ্ঠানের নাম, পণ্যের পরিমাণ কিছুই ঠিকমতো আসছে না। রপ্তানির ক্ষেত্রে এফসিএল কনটেইনারের এমন ঘাপলা উঠে এসেছে কাস্টমসের এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে অ্যাসাইকুডা মডিউল আমদানিকেন্দ্রিক হওয়ায় রপ্তানির তথ্য পূর্ণরূপে প্রদর্শিত হয় না। এছাড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে কনটেইনারের মোট ওজন অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে প্রদর্শনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ডিপোতে থাকা রপ্তানির দলিলাদি যাচাই ছাড়া রপ্তানির তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের করা একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে সব প্রতিষ্ঠানের নাম ও পণ্যের পরিমাণ সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় প্রমাণও পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, পরে কাস্টমস বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলেই এসব প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করতে পারবে না। উল্লেখ্য, যে কনটেইনারে শুধুমাত্র একজন আমদানিকারকের পণ্য থাকে সেটিকে বলা হয় এফসিএল (ফুল লোড কনটেইনার)।
এনবিআর সূত্রমতে, ‘রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টস জাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এফসিএল কনটেইনারের পূর্ণ লোডিং ক্যাপাসিটি নিরূপণ এবং এফসিএল লোডিংয়ে কোনো অস্বাভাবিক রেঞ্জ থাকলে সেটি অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের মাধ্যমে প্রদর্শন এবং কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হওয়ার সম্ভাব্য কারণসমূহ অনুসন্ধানপূর্বক’ একটি প্রতিবেদন দিতে ২১ জুন কমিটি গঠন করে এনবিআর। কমিটির আহ্বায়ক হলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার (বর্তমানে অতিরিক্ত কমিশনার) মোহাম্মদ তফছির উদ্দিন ভূঁঞা, সদস্য সচিব কাস্টমস গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মতিন তালুকদার ও সদস্য উপকমিশনার মো. নুরুল বাসির। এছাড়া কমিটিতে একজন রাজস্ব কর্মকর্তা ও তিনজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে সদস্য করা হয়। কমিটি অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে ৩০ অক্টোবর প্রতিবেদন দেয়। কমিটির সদস্যরা সভা করেন, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল) ও ইসহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (ইবিআইএল) ডিপো সরেজমিন পরিদর্শন করেন। দুই ডিপোয় দুটি কনটেইনার সংশ্লিষ্ট সব বিল অব এক্সপোর্টের পণ্যসমূহের শতভাগ কায়িক পরীক্ষা ও স্টাফিং কার্যক্রম তদারকি করা হয়।
ডিপোর কর্মকর্তারা কমিটিকে জানিয়েছেন, রপ্তানির সময় একটি কনটেইনারে সাধারণত বিভিন্ন শিপার বা রপ্তানিকারকের পণ্য থাকে। কিন্তু রপ্তানিসংক্রান্ত দলিল, কনটেইনার শিটে কোন কোন শিপিং বিলের পণ্য থাকেÑ তা উল্লেখ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্দিষ্ট কোনো বিল অব এক্সপোর্টে বিভিন্ন ধরনের কাপড় দ্বারা তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে বিধায় একটি কনটেইনারের লোডিং করা পণ্যের ওজন ভিন্ন হয়ে থাকে। কমিটির সদস্যরা দুইটি ডিপোয় দুটি কনটেইনারের তথ্য যাচাই করেন।
এসএপিএল ডিপোর একটি কনটেইনার অ্যাসাইকুডা হতে যাচাই করে দেখা গেছে, অবনী নিটওয়্যার লিমিটেড নামীয় গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এসএপিএল ডিপো দিয়ে পোশাক রপ্তানি করেছে। বিল অব এক্সপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ৪০ এইচ সি কনটেইনারে মাত্র ২৬৯.৭০ কেজি পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু ডিপোতে থাকা দলিলাদি যাচাইয়ে দেখা গেছে, ওই কনটেইনারে ১৯টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে মোট ৮ হাজার ৯৯০.৯০ কেজি টি-শার্ট, প্যান্ট ও নারীদের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। চারটি পোশাক প্রতিষ্ঠান টেসকো স্টোর লিমিটেড নামীয় একই ক্রেতার কাছে ওই কনটেইনারে এই পোশাক রপ্তানি করেছে। কিন্তু অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে ওই কনটেইনারের অবনী ছাড়া অন্য কোনো রপ্তানিকারক ও তাদের পণ্যের নাম নেই। অথচ অবনী ছাড়াও ওই কনটেইনারে আরও চারটি শিপারের ৮ হাজার ৭২১.২০ কেজি পণ্য ছিল।
অপরদিকে, ইবিআইএল ডিপোর একটি কনটেইনার অ্যাসাইকুডা হতে যাচাইয়ে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৪ জুলাই গাজীপুরের এসএমএইচ নিউ জেনারেশন অ্যাপারেলস লিমিটেড একটি ৪০ এইচকিউ কনটেইনারে ৮৮.৭৫ কেজি লেডিস সোয়েটার রপ্তানি করেছে। কিন্তু ডিপোর কাগজপত্র যাচাইয়ে দেখা গেছে, ওই কনটেইনারে সাতটি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে ৮ হাজার ৮০০.১২ কেজি বিভিন্ন ধরনের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। ওই কনটেইনারে এসএমএইচ নিউ জেনারেশন ছাড়াও আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানের ৮ হাজার ৭১১.৩৭ কেজি পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টস জাতীয় পণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে এফসিএল কনটেইনারের পূর্ণ লোডিং ক্যাপাসিটি নির্ধারণের জন্য এসএপিএল ও ইবিআইএল ডিপো পরিদর্শন ও সেখান থেকে নেয়া রপ্তানি সংক্রান্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা গেছে, কনটেইনারের লোডিং ক্যাপাসিটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত পক্ষে সিবিএমকে মৌলিক এক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সাধারণত ২০ ও ৪০ ফিট, ৪০ ও ৪৫ এইচ সি কনটেইনারে যথাক্রমে ৩০, ৬০, ৭০ ও ৮০ সিবিএম এর পণ্য লোডিং করা হয়ে থাকে। গার্মেন্টসের ধরন অনুযায়ী, কোনো একটি কনটেইনারে সিবিএম একই হওয়া সত্ত্বেও ওজন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। ডেনিম জাতীয় পণ্যের ওজন অন্যান্য গার্মেন্টস জাতীয় পণ্য যেমনÑজার্সি জাতীয় টি-শার্ট, সুইট শার্ট, পুল ওভার, ওভেন শার্ট, প্যান্ট হতে বেশি হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টস জাতীয় পণ্যের ওজন কনটেইনারে সাইজ অনুযায়ী হয়ে থাকে। দেখা গেছে, ডেনিম দ্বারা তৈরি পোশাকের ২০ ফিটের একটি কনটেইনারের সিবিএম ৩০ হলে ওজন হয় ৯-১০ মেট্রিক টন। ৪০ ফিটের একটি কনটেইনারের ৬০ সিবিএম হলে ওজন হয় ১৪-১৫ মেট্রিক টন। জার্সি ও অন্যান্য কম ওজনের কাপড় দ্বারা তৈরি পোশাকের ২০ ফিটের একটি কনটেইনারের সিবিএম ৩০ হলে ওজন হবে ৫-৬ মেট্রিক টন। ৪০ ফিট বা ৪০ বা ৪৫ এইচ সি কনটেইনারের সিবিএম ৬০-৮০ হলে ওজন হবে ১০-১২ মেট্রিক টন। পোফার জ্যাকেট ২০ ফিটের সিবিএম ৩০ হলে ওজন হবে সাড়ে তিন টন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের মডিউল বর্তমানে আমদানিকেন্দ্রিক হওয়ায় এতে রপ্তানির তথ্য পূর্ণরূপে প্রদর্শিত হয় না। রপ্তানির ক্ষেত্রে কনটেইনারের মোট ওজন অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে প্রদর্শনের কোনো ব্যবস্থা নেই। বরং এক্সপোর্ট বিল অব এন্ট্রির তথ্যানুযায়ী ওয়ে বিল হয়ে থাকে এবং কনটেইনারের ওজন শিপিং বিলের গ্রস ওজন অনুযায়ী প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
সমস্যা সমাধানে কমিটির সদস্যরা প্রতিবেদনে ছয়টি সুপারিশ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ প্রথমত, কোনো শিপিং বিলের বিপরীতে যে কনটেইনার দিয়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে, সেই কনটেইনারটি ওয়েল বিলে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা; যাতে ওই কনটেইনার দিয়ে অন্য কোনো পণ্য রপ্তানি হয়েছে কি নাÑ তা নিশ্চিত হওয়া যায়। কনটেইনারটির টাইপ যেমন এলসিএল বা এফসিএল অনুযায়ী কনটেইনারের ওজন (ভিজিএম) প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, বিল অব এক্সপোর্টে রপ্তানিতব্য পণ্যের কনটেইনার নম্বর প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা সময় সাপেক্ষ। তবে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতি বছর অডিট করার পাশাপাশি তদারকি করার জন্য বন্ড কমিশনারেটকে চিঠি দেয়া যেতে পারে। শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জেনারেল বন্ডের মেয়াদ তিন বছর হওয়ায় ও প্রাপ্যতা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ কর্তৃক প্রদান করার হয় বলে অডিট করার জন্য চিঠি দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠান অডিট করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। প্রকৃত ফাঁকি বের করার জন্য জেনারেল বন্ডের মেয়াদ প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকের ন্যায় এক বছর করা যেতে পারে।
চতুর্থত, ফ্রেইট ফরোয়াডার্স কর্তৃক ইজিএম বা বিল অব লোডিং দাখিলকালীন কনটেইনারের বিবরণীসহ মোট ওজন উল্লেখ করার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। পঞ্চমত, ইজিএম পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। ষষ্ঠত, অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে কনটেইনার দিয়ে ওয়েল বিল সার্চ করার সময় কনটেইনার টাইপ এবং ওজন প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা।
আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হওয়ার কারণ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানির প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়। বন্ড কমিশনারেট যেকোনো প্রতিষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট বছরের অডিট সম্পন্ন করে থাকে। যদি নিয়ম অনুযায়ী অডিট সম্পন্ন করে, তাহলে আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হওয়ার সুযোগ নেই। শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামালের বন্ডিং মেয়াদ দুই বছর। সেজন্য ক্রেতা বা বায়ারের নির্দেশনা অনুযায়ী সেই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়ে থাকে। ক্যালেন্ডার ইয়ারের শেষের দিকে যে কাঁচামাল আমদানি করা হয়, তা সাধারণত সেই ইয়ারে রপ্তানি করা সম্ভব হয় না। সাধারণত সেই কাঁচামাল দ্বারা তৈরি পোশাক পরবর্তী বছর বা তার পরের বছরেও রপ্তানি করার সুযোগ থাকে। সেজন্য অ্যাসাইকুডা থেকে নির্দিষ্ট বছরের আমদানি-রপ্তানির তথ্য যাচাই করা হলে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
আরও বলা হয়েছে, প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকের ক্ষেত্রে জেনারেল বন্ডের মেয়াদ এক বছর ও বন্ড কমিশনারেট থেকে বার্ষিক প্রাপ্যতা দেয়া হয়। ফলে জেনারেল বন্ডের মেয়াদ বৃদ্ধি ও আমদানি প্রাপ্যতার জন্য সংশ্লিষ্ট বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রতি বছর অডিট করা হয়। শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কী ধরনের পণ্য আমদানি করতে পারবে, তা সেই কমিশনারেট ক্রেতা বা বায়ারের চাহিদা পর্যালোচনা করে এইচএস কোড অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু সেই এইচএস কোডের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রাপ্যতা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ প্রদান করে থাকে। শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জেনারেল বন্ডের মেয়াদ তিন বছর হওয়ায় প্রাপ্যতাসংক্রান্ত কোনো জটিলতার উদ্ভব না হওয়ায় অডিট করার জন্য বারবার চিঠি দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর অডিট করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। ফলে নির্দিষ্ট বছরের আমদানি-রপ্তানির সঠিক তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয় না।