ওষুধশিল্পে আমাদের সাফল্য বিস্ময়কর। কভিড মহামারির প্রভাবে দেশের বেশিরভাগ শিল্পের আয় ব্যাপকভাবে কমেছে। বিপরীত চিত্র ছিল ওষুধশিল্প খাতে। প্রকৃত ও সরকারিভাবে তথ্য প্রকাশ করা না হলেও এ খাতের উদ্যোক্তাদের তথ্যমতে, কভিডকালে দেশের ওষুধের বাজারে ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতি বছর দেশীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে ওষুধ রপ্তানি হয় বিশ্বের প্রায় ১৬৫ দেশে। রপ্তানি আয় প্রতি বছরই বাড়ছে, জীবনরক্ষাকারী ওষুধও তৈরি হচ্ছে দেশে।
আমাদের কতকগুলো ওষুধ ‘নিরাপদ ও কার্যকর’ বলে স্বীকৃতি ও ব্যবহারে অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গুড জিএমপি, গুডস থেরাপিউটিক গুডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-সহ (টিজিএ অস্ট্রেলিয়া) উন্নত দেশগুলোর ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
অথচ ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনের দুই ঘটনায় ১০৪ শিশুর মৃত্যুতে ওষুধ প্রশাসনের ‘কঠিন দায়’ রয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ১০৪ শিশুর প্রত্যেকের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়ে গত বছর যে রায় হাইকোর্ট দিয়েছিলেন, সেখানে এসব পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা এসেছে। হাইকোর্ট ২০২২ সালের ২ জুন ওই রায় ঘোষণা করেন। বুধবার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
রায়ের আট দফা নির্দেশনার কয়েকটি হলো: বিনা মূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার এবং এ অধিকার তার বেঁচে থাকার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করতে হবে। ওষুধে ভেজাল মিশ্রণ বন্ধে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ২৫(সি) অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ ওই ক্ষতিপূরণের টাকা সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তি ও ওষুধ কোম্পানি থেকে আদায় করতে পারবে। একটি স্বাধীন ‘জাতীয় ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করতে হবে।
বিশ্বমানের ওষুধ তৈরি ও রপ্তানিতে সাফল্য যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে লক্ষ্যে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা আখ্যা দিয়ে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডফ্লেম ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবন করে ১৯৯১ সালে ৭৬ শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর ২০০৯ সালে রিড ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে আরও ২৮ শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগে মামলা হয়।
ওষুধ প্রস্তুতকারকদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে শুধু তারা প্রতিটি ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে। দেশে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া ওষুধের বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয় না। ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন প্রতিটি পর্যায়েই নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি করা উচিত।
ওষুধ আর ১০টি নিত্যপণ্যের মতো নয়। একটু অসতর্কতায় জীবনরক্ষাকারী ওষুধও প্রাণঘাতী হয়, এটি আমরা প্রমাণ করেছি। দেশের কোথাও যাতে মানহীন নিম্নমানের ওষুধ তৈরি ও বিপণন হতে না পারে, সে লক্ষ্যে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেই প্রত্যাশা।