দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন বেশ উত্তাল। নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলই এখন আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। জনসমর্থনে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকা প্রভাবশালী দুই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও ধীরে ধীরে তাদের নির্বাচনী সব প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই দুই দল দেশের বিভিন্ন জেলা এবং বিভাগগুলোতে নিজেদের বিভাগীয় সমাবেশ শেষ করেছে। এখন সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, একটি সুপ্ত ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ জনগণকে উপহার দেয়া। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা ত্রুটিমুক্ত হবে, এটিই এখন সবার প্রশ্ন।
সম্প্রতি রাজনৈতিক সমঝোতা ও বর্তমান আস্থাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে সংস্কার না এনেই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তফসিল ঘোষণা, এ শঙ্কাকে আরও জোরালো করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, একতরফা নির্বাচন করতেই এমন অপরিকল্পিত তফসিল। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল বেশ ইতিবাচকতার সঙ্গেই এ সিদ্ধান্তকে স্বাগতম জানিয়েছে। তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হরতাল ও অবরোধ পালন করছে জামায়েতে ইসলাম এবং বিএনপি। এ যখন পরিস্থিতি, তখন একতরফা নির্বাচনের শঙ্কা কতটা সত্য এবং বাস্তবিক, তা এখনই খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের জনগণ এর আগেও একতরফা নির্বাচন দেখেছে। পরোক্ষ কিংবা প্রতক্ষ্য সে যেভাবেই হোক ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনই আবারও এ শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনটি ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নির্বাচন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় ২০১১ সালেই। ২০১৪ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে ২০১৩ সালে দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেহেতু বিএনপির প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছিল, সুতরাং ধারণা করা হচ্ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে বিএনপি কোনো আপত্তি করবে না। কিন্তু সে ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলে। সে সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগদান এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব তোলেন। কিন্তু বিএনপি তাও নাকোচ করে দিয়ে জামায়েতের সঙ্গে জোট বেঁধে দেশে আগুন, সন্ত্রাস ও জ্বালাও পোড়াওয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলে। ফলস্বরূপ সে সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করা তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে হয়ে যায় সংসদের প্রধান বিরোধী দল এবং সরকার পক্ষের দল। রওশন এরশাদ তখন সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে তার দলের নির্বাচিত বাকি সদস্যদের নিয়ে বিরোধী দলের আসন অলংকৃত করেন। পরে সে নির্বাচন একতরফা বলে বর্জন করে প্রধান বিরোধী দলসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এবং এ ঘটনা ছিল দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।
এরপর ২০১৮ সালে আবারও একই কায়দায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি এবার নির্বাচনে প্রার্থী দেয়। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর, একমাত্র ২০১৪ সালটিই ছিল বিএনপির জন্য ভিন্ন। কেননা ২০১৪-এর নির্বাচন থেকে ২০১৮-এর নির্বাচন এর আগ অবধি সংসদে বিএনপির কোনো সদস্য ছিল না, ফলস্বরূপ নেতৃত্বে ভাটা পড়ার শঙ্কায় বিএনপি ২০১৮ নির্বাচনে বেশ ইতিবাচকভাবেই অংশগ্রহণ করে। যদিও তখনও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে দলটি বেশ শঙ্কিত ছিল। পরে এ নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। দেশের প্রায় সব বিরোধী দল এবং সাধারণ জনগণও এ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক নির্বাচন হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ নির্বাচনের বদনাম এখন আন্তর্জাতিক মহলেও। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এ যখন পরিস্থিতি, তখন আগামী ২০২৪Ñএ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তোলা এবং একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে ভোট সম্পাদন করা, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য সত্যিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। হুদা কমিশনের চাইতে আউয়াল কমিশন কতটা ভিন্ন কিংবা এক এখন তাই-ই দেখার বিষয়। যদিও জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে লক্ষ্মীপুর-৩ আসন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচন ঘিরে যে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, তা এ নির্বাচন কমিশনের সু®ু¤ নির্বাচন করার সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এখনই।
সে যাই হোক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ একতরফা নির্বাচনকে গণতন্ত্রবিরোধী বলে মনে করে। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলের নানান চাপ সামলাতে ব্যস্ত ক্ষমতাসীন দল। আগমীতে হয়তো দেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন অনেক ঘটনাই ঘটানো হবে, যাতে নির্বাচন কমিশনের কোনো দায় থাকবে না। ক্ষমতাসীন দল নিজেদের শক্তির জোগান দিতে কিংবা বিরোধী দল ক্ষমতা দেখাতে এমন অনেক পরিস্থিতিই সামনে তৈরি করবে, যা সম্পূর্ণ নৈতিকতাবিরোধী, ঠিক যেমনটা এখন হচ্ছে। তবে, নির্বাচন কমিশন এখন থেকেই শক্তিশালী পদক্ষেপ এবং সুপরিকল্পিতভাবে পরিবেশ পরিবর্তনের চেষ্টায় নিয়োজিত না হলে এসব ঝামেলা সামাল দিতে ভবিষ্যতে সত্যিই খুব বেগ পেতে হবে। আরও একবার যদি দেশে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কিংবা আরও একবার যদি বিরোধী দলহীন সংসদ দেখতে হয়, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এ কথা বোধ হয় কাগজে কলমেই জীবিত থাকবে, বাস্তবে তা অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে অনেক আগেই।
মারিয়া হক শৈলী
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা