ব্যাংক হলো আর্থিক লেনদেন মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান কাজ বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে আমানত গ্রহণ করা, ঋণ দেয়া, ঋণ বা বিনিয়োগ করা। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক কোনো দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। গ্রাহকের আমানতগুলো সংরক্ষণ করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। যেকোনো দেশের অর্থবিষয়ক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তায় বিভিন্ন ধরনের সঞ্চিতি তহবিল সংরক্ষণের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে একটি হলো নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন। মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করায় একদিকে যেমন ব্যাংকের আয় কমে যায়, অন্যদিকে ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান শক্তিশালী হয়। সুতরাং ব্যাংকের আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী করার জন্যই খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য, গত ৩০ সেপ্টেম্বর তিনটি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ৯টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা; যা আগের প্রান্তিকে আট ব্যাংকে ছিল ২৬ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ২ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতির প্রায় ৪৮ শতাংশই ন্যাশনাল ব্যাংকের।
নিয়মানুযায়ী, বাধ্যতামূলক সব ধরনের ঋণের বা বিনিয়োগের ওপর সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণের পর ব্যাংককে রিজার্ভ তহবিলে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। মুনাফার একটি অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়, বাকি অংশ রিটেইন আর্নিং হিসেবে ব্যাংক সংরক্ষণ করে। মূলত ব্যাংকের আর্থিক কাঠামোর ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্যই প্রভিশন সংরক্ষণ করার বিধান চালু করা হয়েছে। আমানতকারীদের জমা করা অর্থের নিরাপত্তা দিতে ব্যাংকগুলোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। আর প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে যায়। জানা যায়, কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। নিয়মানুযায়ী প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারে না। আবার ঘাটতি থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ওই ব্যাংকের চার্জ বেশি লাগে।
এখন প্রায়ই দেখা যায় আমাদের ব্যাংকগুলো প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। যেহেতু আমানতকারীদের জমা করা অর্থের নিরাপত্তা দিতেই ব্যাংকগুলোর জন্য প্রভিশন সংরক্ষণ বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি প্রমাণ করে ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণে আগ্রহী নয় তারা। অথচ পর্যাপ্ত প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়ে; ব্যাংকের খরচও কমে। কেননা ঋণ নিয়মিত থাকলে জেনারেল প্রভিশন এক শতাংশ সংরক্ষণ করতে হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত প্রভিশনসংক্রান্ত নিয়ম পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা। খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে এবং আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না বাড়লে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। নানা প্রতিকূল অবস্থায় দেশের আর্থিক কাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক সুবিধা দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। বিভিন্ন ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণে আশাব্যঞ্জক ফল আসেনি।
কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হলে সেই ব্যাংক কোনো নতুন শাখা খুলতে পারে না; ক্যামেল রেটিং খারাপ হয়; ব্যাংকের তহবিল ব্যয় বেড়ে যায়; পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারমূল্য কমে; বৈদেশিক বাণিজ্য করার জন্য শাখা খোলার অনুমোদন পায় না; ব্যাংকের রিটেইন আর্নিং ও শেয়ারপ্রতি আয় কমে যায় এবং ওই ব্যাংক বছর শেষে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এত ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণে তৎপর নয়, এটি দুঃখজনক। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি সংরক্ষণের ব্যাসেল কমিটি প্রণয়ন করেছে ব্যাসেল আদর্শ। সব ব্যাংককে ব্যাসেল আদর্শ মেনে চললে ঋণঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ব্যাংকগুলোয় ব্যাসেল আদর্শ সঠিকভাবে পরিপালনের মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি হ্রাস ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে।