দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস পরিস্থিতি, অন্যদিকে ব্যাংকে বাড়ছে কোটি টাকা আমানতের হিসাবের সংখ্যা। দৈনিক শেয়ার বিজে গতকাল ‘এক বছরে কোটি টাকার আমানতকারী বেড়েছে সাত হাজার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এক বছরের ব্যবধানে দেশের ব্যাংকগুলোয় কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে সাত হাজার ৬৬টি। এর ফলে দেশে বর্তমানে কোটি কোটি টাকার ওপরে রয়েছে, এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবের সংখ্যা এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬টিতে দাঁড়িয়েছে। কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা যখন বাড়ছে, তখন চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করাই দুরূহ হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকে কোটি টাকার হিসাব বৃদ্ধির বিষয়টি সমাজে আয়বৈষম্য বৃদ্ধির বিষয়টি নির্দেশ করে। এই আয়বৈষম্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
আমরা জানি, সমাজে আয়বৈষম্য হ্রাসের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার প্রচলন ঘটানো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল কর কাঠামোতে সাধারণত প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে বেশি রাজস্ব আহরিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এখানে অধিকাংশ রাজস্ব আহরণ হয় পরোক্ষ ব্যবস্থার মাধ্যমে। আর পরোক্ষ করের বোঝা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার ওপর সমনভাবে পতিত হয়। এর ফলে উচ্চ আয়ের মানুষরা কম কর পরিশোধের সুযোগ পান। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়তে থাকে। এ ব্যবস্থা পরিবর্তন হওয়া জরুরি।
এ কথা সত্য যে, দেশে বেশি আয় করলে বেশি হারে এবং কম আয় করলে কম হারে আয়কর পরিশোধের সুযোগ আছে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ কর এখনও উৎসে আয়কর কর্তনের মাধ্যমে আহরিত হয়। সাধারণত বিভিন্ন সেবা ও পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের এই উৎসে করের জোগান দিতে হয়। এর বাইরে আমদানি শুল্কের বোঝা নিপতিত হয় পণ্য ও সেবার ওপর। পাশাপাশি রয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট। এসব কর সব ধরনের নাগরিকের ওপর সমানভাবে পতিত হয়। এর ফলে নিম্নআয়ের মানুষকেও উচ্চ আয়ের মানুষের সমপরিমাণ কর পরিশোধ করতে হয়। ফলে উচ্চ আয়ের মানুষের কম হারে কর পরিশোধের সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের আয় অধিকহারে বাড়ানোর সুযোগ পায়। অন্যদিকে বাড়তি করের বোঝা বইতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ আরও বেশি হারে প্রাপ্তিকতার শিকার হন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে একটি প্রগতিশীল ও প্রত্যক্ষ করনির্ভর রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে আয়বৈষম্য হ্রাসে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে প্রান্তিক জগগোষ্ঠী আরও বেশি মাত্রায় প্রান্তিকতার শিকার হবেন এবং মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমন বাস্তবতায় সরকার আয়বৈষম্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।