বিলুপ্ত বিজেসির সিংহভাগ সম্পদ বেদখল

জাকারিয়া পলাশ: ১৯৯৩ সালে বিলুপ্ত ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি)। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচা পাট কিনে পাটকলগুলোয় সরবরাহ করতো। বিলুপ্ত ঘোষণার পর প্রতিষ্ঠানটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২৩ বছর পরও সিংহভাগ সম্পত্তি অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে। বেদখল হয়েছে অধিকাংশ সম্পত্তি। এ নিয়ে রয়েছে মামলা-মোকদ্দমা। বিপুল সম্পদের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এর বিলুপ্তি সম্ভব নয় বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

সূত্রমতে, ১৯৮৫ সালের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বিজেসি। বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা লোপ পাওয়া, অব্যাহত লোকসান, অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনবৈষম্যসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার এক হাজার ১০০ কোটি টাকা লোকসান দেখিয়ে বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই সময় বিজেসিতে তিন হাজার ১২৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ১০৯, দ্বিতীয় শ্রেণির ২৪৮, তৃতীয় শ্রেণির ৯৯১ ও চতুর্থ শ্রেণির এক হাজার ৭৮০ জন। বিলুপ্তির পর বিজেসির প্রেস হাউজ, পাট ক্রয়কেন্দ্র, গুদাম এবং অন্যান্য অঙ্গন ও সম্পত্তি বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত তার ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা বিধান, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২৪৪ লোকের চাকরি বহাল রাখা হয়। বাকিদের অবসর দেওয়া হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই অবসরে গেছেন। জনবল সংকটের কারণে বিলুপ্ত সংস্থাটির বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে বেশিরভাগ জমি বেদখল হয়ে যায়।

বিজেসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৯৩ সালে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩০০ পাট ক্রয়কেন্দ্র ও ২৪০টি অঙ্গন (উম্মুক্ত জমি) মিলে ৬৭৫ দশমিক ৭৬ একর জমির মালিকানা ছিল  বিজেসির। তখন থেকে পাট কেনাবেচাসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ওইসব অঙ্গনে। এছাড়া পাঁচ মণ ওজনের কাঁচা পাট মেশিনে চেপে ছোট আকারের গাঁইট বানানোর জন্য ২৪টি প্রেসার হাউজ ছিল বিজেসির মালিকানায়।

সূত্রমতে, এ পর্যন্ত ২৪০টির মধ্যে মাত্র ৯২টি অঙ্গন বিক্রি করতে পেরেছে বিজেসি, যার পরিমাণ প্রায় ৩৯৩ একর। বিক্রি হওয়া ওই জমি বাবদ সরকার পেয়েছে ১৮৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। কিন্তু এখনও প্রায় ১৬১টি অঙ্গনের ২৮২ একর জমি অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে, যার মূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে বিলুপ্ত বিজেসি কর্মকর্তারা জানান, বিক্রি না হওয়া অধিকাংশ সম্পত্তি বেদখল অবস্থায় রয়েছে। বিজেসির সহ-সচিব মো. রেজাউল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিলুপ্ত ঘোষণার পর থেকে বিজেসিতে লোকবল নিয়োগ বন্ধ। ফলে ক্রমান্বয়ে জনবলশূন্য হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিলুপ্ত ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালীরা এই প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি দখল ও লুটপাট শুরু করেছে। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা চালাচ্ছে বিজেসি।’

সূত্রমতে, বিজেসির সম্পত্তি নিয়ে ২১৮টি মামলা রয়েছে। এছাড়া গুদামের ভাড়াসহ অন্যান্য ইস্যুর মামলা মিলে মোট মামলাসংখ্যা ২৬৭টি। এর মধ্যে ৮৪টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। বিলুপ্তির পর থেকে ২৩ বছরে এ পর্যন্ত ১২৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। যার ৮০টিতে বিজয়ী হয়েছে বিজেসি।

এছাড়া, বিজেসির বিভিন্ন আর্থিক কার্যক্রম নিয়ে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। বিগত ২৩ বছরে ১৮৬০টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘এসব মামলা ও অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হলে এই বিশাল সম্পত্তি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিলুপ্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে নিতে হচ্ছে।’

সমগ্র বাংলাদেশে বিজেসির প্রায় ১০১৫ কোটি টাকার ২৮৬.১০ একর সম্পত্তি অবিক্রীত রয়েছে। এ পর্যন্ত ৯২টি সম্পত্তি বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রিলব্ধ অর্থের পরিমাণ ২০০.৮৪ কোটি টাকা, যা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। অবশিষ্ট ১৪৩টি অঙ্গনের সম্পত্তি বিক্রি প্রক্রিয়াধীন। এ অবিক্রীত সম্পত্তিতে মামলা-মোকদ্দমা, বেদখল ও রেকর্ডপত্রে গরমিল থাকায় বিক্রি প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ও দেশের বিভিন্ন আদালতে বিজেসির বিচারাধীন মামলাসংখ্যা ২১৮টি ও নিরীক্ষা আপত্তির সংখ্যা ৭১২টি।

উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে পাট ক্রয়-বিক্রয় ও বাজারজাতকরণে সরকারি মালিকানাধীন পাঁচটি সংস্থাকে একীভূত করে বিজেসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই সংস্থাগুলো সম্পর্কে বিজেসির সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান, ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সরকার কৃষকের কাছ থেকে পাট কেনার জন্য বাংলাদেশ জুট মার্কেটিং করপোরেশন চালু করেছিল। পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাট কেনার জন্য সরকারি দফতর, গোডাউন ও উম্মুক্ত স্থান (অঙ্গন) কেনে সরকার। ওইসব ক্রয়কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানের জন্য জুট ট্রেডিং করপোরেশন নামে আরেকটি সংস্থা চালু হয় ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর দেশ ছেড়ে চলে যওয়া লোকদের পরিত্যক্ত সম্পদ অধিগ্রহণ করে সরকার পাট খাতের উন্নয়নে বরাদ্দ দেয়। ওই সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৬৫ সালে স্পেশাল প্রপারটি জুট সেল গঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলে রেলি ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান পাট ক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে ওই প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় সরকার। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয় এপিসি রেলি বাংলাদেশ লিমিটেড। এছাড়াও কাঁচা পাট মেশিনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে গাঁইট বানিয়ে রফতানিযোগ্য করার জন্য ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ জুট এক্সপোর্ট করপোরেশন। এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান একীভূত করেই বিজেসি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যা বিলুপ্ত হয় ১৯৯৩ সালে।

 

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০