অরবিন্দ পানাগড়িয়া: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রায় ৫০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ও বাণিজ্য-সংক্রান্ত সাধারণ চুক্তির (জিএটিটি) মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যকে উদারীকরণের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি বহুপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ১২৩টি দেশকে একত্র করেছিল। এতে জিএটিটি’কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি পরিষেবা বাণিজ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিকেও এর আওতায় আনা হয়।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এত কাঠখড় পুড়িয়ে গড়ে তোলা বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য অস্তিত্বের হুমকি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শিল্পনীতি। ওয়াশিংটনে এখন দুইদলীয় মতামত দেখা যাচ্ছে। তা হলো, ডব্লিউটিও যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বেখেয়ালে চীনকে সিস্টেমের সুবিধা নেয়ার অনুমতি দিয়ে একটি শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করেছে। এই উপলব্ধি থেকেই মূলত ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান উভয় প্রশাসনকেই এমন সব পদক্ষেপ নিতে হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা এ প্রতিষ্ঠানের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।
২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থায় (ডিএসবি) নতুন বিচারকদের অনুমোদন দিতে অস্বীকার করেছে এবং যাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে তাদের পুনর্নিয়োগ আটকে দিয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ডিএসবির সদস্যসংখ্যা কমিয়ে একজন করা হয়, যেখানে মামলার বিচারের জন্য অন্তত তিনজন সদস্য প্রয়োজন। ফলে ডব্লিউটিওর সদস্যদের মধ্যে বাণিজ্যবিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকর আর কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে সদস্য দেশগুলোর জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে এমন নীতি গ্রহণ করার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে।
মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ক্রমাগতভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করে চলেছে। ২০১৮ সালে ডিএসবি কার্যকরভাবে কাজ বন্ধ করে দেয়ায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমদানিকৃত ওয়াশিং মেশিন ও সোলার প্যানেলের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এর কিছুকাল পরই ট্রাম্প প্রশাসন অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত ও অনেকগুলো চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণা করে।
ট্রাম্পের আরোপ করা শুল্ক তুলে নেয়ার বদলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শিল্পনীতি গ্রহণ করে বাড়তি বাণিজ্য বাধা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সেমিকন্ডাকটর, বৈদ্যুতিক যানবাহন ও অফশোর বায়ুশক্তির জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের উৎপাদন ভর্তুকি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ইউক্রেনে আগ্রাসন, যার কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য এরইড মধ্যে অনিশ্চিত দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও জটিল করে তুলেছে। উপরন্তু ট্রাম্প ২০২৫ সালে হোয়াইট হাউসে ফিরে গেলে বেশিরভাগ আমদানির ওপর ১০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক আরোপ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এ পদক্ষেপগুলো এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে মন্থর করেনি। কভিড-১৯ মহামারির সময় থেকে বিশ্বব্যাপী পণ্য রপ্তানি দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালের ১৯ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন এবং ২০২১ সালের ২২ ট্রিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ২৫ ট্রিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। মার্কিন শুল্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারদের দ্বারা আরোপিত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপগুলোর অর্থনৈতিক প্রভাব তুলনামূলকভাবে সামান্যই পড়েছে। ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও চীনা পণ্যের আমদানিকারকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মার্কিন পণ্যদ্রব্যের বাণিজ্য এমনকি চীনের সঙ্গেও শক্তিশালীই রয়ে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মার্কিন অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান প্রসার অব্যাহত রয়েছে মূলত দেশটির সুবিশাল ও ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক দেশীয় বাজারের কারণে।
অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের মতো কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে উন্নয়নশীল বিশ্ব শুধু ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠার পরই উš§ুক্ত বাণিজ্য গ্রহণ করে। ফলে এসব দেশে বহির্বাণিজ্য বিষয়ক নীতির ব্যাপারে অভ্যন্তরীণ সমর্থন ভঙ্গুর রয়ে গেছে।
এ অবস্থায় সুরক্ষাবাদের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তন দুভাবে উম্মুক্ত বাণিজ্যকে দুর্বল করে। প্রথমত, এটি একটি সুরক্ষাবাদী মানসিকতা লালন করে। বাণিজ্য উদারীকরণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রবক্তা হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তখন তা অন্যান্য দেশকে এমনই ইঙ্গিত দেয় যে, তারাও এ ধরনের পদ্ধতি থেকে লাভবান হতে পারে এবং এতে তাদের আমদানি-প্রতিস্থাপন শিল্পায়ননির্ভর উন্নয়ন কৌশলে ফিরে যেতে উৎসাহিত করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশের নেতারা প্রায়ই মার্কিন শুল্কের প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজনৈতিক চাপের সম্মুখীন হন, যা তাদের রপ্তানির জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারত তার নিজস্ব মার্কিন আমদানিতে শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্পের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছে। এমনকি ভারতের মতো একটি বড় অর্থনীতিতেও মার্কিন অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বাজার শক্তির অভাব রয়েছে। কিংবা এ ধরনের প্রতিশোধমূলক শুল্কের বোঝা বেশিরভাগই তার নাগরিকদের ওপরই পড়বে। ফলে তেমন কোনো লাভও নেই।
যেহেতু উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক ছোট, তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বেগবান করতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের দ্রুত প্রবৃদ্ধি মুক্ত বাণিজ্যের সুফলকেই নির্দেশ করে। একই সঙ্গে প্রকাশ করে কীভাবে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক বাধাগুলো অনেক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক সম্ভবনাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। যদিও বিশ্ব বাণিজ্যে বিভক্তির সম্ভাব্য সমাধান রয়েছে, তবুও ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা ও প্রধান শক্তিগুলোর ‘সেলফ-সার্ভিস’ এজেন্ডা উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ভাঙনের মুখে যে দেশগুলো তাদের বাজারকে মুক্ত রাখতে এবং যতটা সম্ভব অংশীদারদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে, বর্তমান ঝড় মোকাবিলায় তারাই ভালো সুযোগ পাবে।
এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ
অধ্যাপক, অর্থনীতি, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর
শামসুন নাহার