সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়েছে ১৪-২৩ টাকা

নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বহু আগেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে থাকলেও সম্প্রতি এ খাতে জোর দেয়া হচ্ছে। তবে অপরিকল্পিত নানা উদ্যোগ ও বিনিয়োগের ফলে এ খাতের সুফল সুদূর পরাহত হয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশের নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। সরিষাবাড়ীতে নির্মিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র তিন মেগাওয়াট। পরবর্তী ছয় বছরে সরকারি-বেসরকারি আরও ৯টি কেন্দ্র উৎপাদনে আসে। তবে এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেনার ট্যারিফের মাঝে কোনো সামঞ্জস্য নেই। একেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একেক রকম রেটে চুক্তি করা হয়েছে। ফলে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়ও পড়ছে বিভিন্ন ধরনের।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, গত অর্থবছর ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৪ থেকে ২৩ টাকার মতো। এর মধ্যে সরকারি দুটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের মাঝেও রয়েছে বড় ধরনের পার্থক্য। বিপিডিবি ও এনডব্লিউপিজিসিএলের (নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড) নির্মিত কেন্দ্র দুটি সাত মেগাওয়াট করে। তবে বিপিডিবির কেন্দ্রটিতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল ২২ টাকা ৬২ পয়সা। অথচ এনডব্লিউপিজিসিএলের কেন্দ্রে ব্যয় পড়ে ১৩ টাকা ৯২ পয়সা।

এদিকে বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানাধীন আটটি কেন্দ্রের মধ্যে গত অর্থবছর সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে ১৩ টাকা ৬২ পয়সা থেকে ১৯ টাকা ৮২ পয়সা।

তথ্যমতে, রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে নির্মিত বিপিডিবির কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। কাপ্তাই প্রকল্পের ভেতর কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান বাঁধ সংলগ্ন ২৩ একর জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। গত অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার মাত্র ১৪ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৯১ লাখ ১১ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা।

অন্যদিকে এনডব্লিউপিজিসিএলের গ্রিড টাইড সোলার নামক সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে। ২০২১ সালের ৩০ মার্চ উৎপাদন শুরু করা কেন্দ্রটির সক্ষমতার ১৮ শতাংশ ব্যবহার হয় গত অর্থবছর। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৭৯ হাজার ইউনিট।

বিপিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে রয়েছে দেশের সবচেয়ে ছোট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। তিন মেগাওয়াট সক্ষমতার বেসরকারি খাতের এ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে জার্মানির আইএফই এরিকসন এজি এবং দেশীয় কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড ও জুপিটার এনার্জি লিমিটেড। এই তিন প্রতিষ্ঠান মিলে গঠন করেছে যৌথ বিনিয়োগ কোম্পানি ‘আইএফই-সিপিসি-জেইএল কনসোর্টিয়াম’।

ইনগ্রিন সোলার নামক দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর উৎপাদন হয় ৪১ লাখ ৬৯ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার ১৬ শতাংশ। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে ১৯ টাকা ৮২ পয়সা, যা বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ।

এদিকে ২০২০ সালের নভেম্বরে উৎপাদনে আসে বেসরকারি খাতের এইচডিএফসি সিনপাওয়ার লিমিটেড। ময়মনসিংহে নির্মিত ৫০ মেগাওয়াটের এ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে যৌথ বিনিয়োগ করেছে সিঙ্গাপুরের সিনএনার্জি হোল্ডিং পিটিই লিমিটেড ও বাংলাদেশের এইচডিএফসি সোলার পাওয়ার লিমিটেড। গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৯ কোটি ৫৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার ২২ শতাংশ। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৭ টাকা ৭৯ পয়সা, যা বেসরকারি খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

গত বছর ২৮ আগস্ট উৎপাদন শুরু করে ইন্ট্রাকো সোলার পার্ক। লালমনিরহাটে নির্মিত ৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটির সক্ষমতার ১৯ শতাংশ ব্যবহার হয় গত বছর। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ কোটি ইউনিট। ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৭ টাকা আট পয়সা। আর চলতি বছর ৮ জুন উৎপাদন শুরু করে দেশের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তিস্তা সোলার পার্ক। বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন এ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ২০০ মেগাওয়াট। গত অর্থবছর এর সক্ষমতার ১৯ শতাংশ ব্যবহার হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৬ কোটি ২১ লাখ ইউনিট, যার গড় ব্যয় ছিল ১৬ টাকা ১৩ পয়সা।

টেকনাফে ২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করেছে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর। টেকনাফ সোলারটেক এনার্জি নামক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জুলস পাওয়ার লিমিটেড (জেপিএল)। নাফ নদীর তীরে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার ২২ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে গত অর্থবছর। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৯২ কিলোওয়াট ঘণ্টার বেশি, যা সক্ষমতার ২২ শতাংশ। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৪ টাকা ৫৭ পয়সা।

২০২১ সালের মার্চে উৎপাদন শুরু করে মানিকগঞ্জের শিবালয়ের স্পেকট্রা সোলার। ৩৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চীনের স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড ও সুনফেন ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড যৌথভাবে বিনিয়োগ করেছে। কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ছয় কোটি ৩৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার ২১ শতাংশ। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে গড়ে ১৪ টাকা ৫৩ পয়সা।

বাগেরহাটের মোংলায় ১০০ মেগাওয়াটের এনারগন রিনিউয়েবলস (বিডি) লিমিটেড সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে ওরিয়ন গ্রুপ। ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর উৎপাদনে আসা কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর উৎপাদন হয় ১৮ কোটি ৫৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ, যা সক্ষমতার ২১ শতাংশ। এতে গড় ব্যয় পড়ে ১৪ টাকা ৪৫ পয়সা, যা বেসরকারি খাতে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।

এদিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে সিম্পা সোলার পাওয়ার কেন্দ্রটি, যার সক্ষমতা ৮ মেগাওয়াট। তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকায় প্যারাগন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যাকুয়া ব্রিডার্স লিমিটেডের মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ভেতরে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান। সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে নির্মাণ করেছে থাইল্যান্ডের শীর্ষ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিম্বিয়ার সোলার ও বাংলাদেশের প্যারাগন গ্রুপ।

গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় এক কোটি ৩৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার ১৯ শতাংশ। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৩ টাকা ৬২ পয়সা। এটি ছিল গত অর্থবছর দেশের সর্বনিম্ন সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০