সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবৈধ অভিবাসনের ঝুঁকিতে অস্ট্রেলিয়া

ডেভিড ব্রিউস্টার: অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অস্ট্রেলিয়ার জন্য সমুদ্রপথে জনপ্রবেশের একটি প্রধান সম্ভাব্য উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে হাজার হাজার শরণার্থী সমুদ্রযোগে ইন্দোনেশিয়ার দিকে রওনা করায় এ ব্যাপারে চিন্তা কিছুটা বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়া হতে পারে তাদের পরবর্তী বড় গন্তব্য।

বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে কক্সবাজার শহরে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির রয়েছে। এতে প্রায় ১২ লাখ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবস্থান করছে। ২০১৬ সাল নাগাদ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ সরকার তাদের ক্যাম্পে সীমাবদ্ধ রেখেছে। পর্যবেক্ষকদের অবাক করে দিয়ে শরণার্থীরা কমবেশি ধৈর্যের সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে।

রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়া প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে এ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে অস্ট্রেলিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর দ্বিপক্ষীয় সহায়তার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া এখন তৃতীয় অবস্থানে আছে। দেশটির দিক থেকে এ অনুদান মূলত রোহিঙ্গাদের শিবিরে রাখার জন্য একটি বিনিয়োগ, যাতে তারা নৌকাযোগে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাতে না পারে।

কিন্তু এ ভারসাম্য সহজেই এলোমেলো করে দিতে পারে কয়েকটি নতুন পরিবর্তন।

প্রথমত, মিয়ানমারে, বিশেষত রাখাইন রাজ্যে, চলমান গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সহায়তা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ইউক্রেন, ইয়েমেন ও গাজার সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল সরিয়ে নেয়া হতে পারেÑএমন উদ্বেগ উঠেছে। খাদ্যের রেশন প্রতি মাসে ১২ মার্কিন ডলার থেকে আট মার্কিন ডলারে কমানো হয়েছে। আরও কমানোর সম্ভাবনা তৈরি হলে অনেককেই অনাহারে থাকতে হবে, বিশেষত যদি বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের বৈধ কর্মসংস্থানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে।

এদিকে ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি আগের মতোই চলমান। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন-সহ (আরএসও) বিভিন্ন অপরাধী দল ছড়িয়ে আছে। তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড করছে। বিশেষ করে যাদের কাছে টাকা ও খাবার আছে তাদের অপহরণ করছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেরই আয়ের একমাত্র উৎস মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা নামক অ্যাম্ফিটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণের চোরাচালান। গত সপ্তাহে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে একজন শরণার্থীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সশস্ত্র গোষ্ঠী ও নিরাপত্তা বাহিনীর কারণে তরুণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। যখন তারা আর সহ্য করতে পারে না, তখন তারা চোরাকারবারিদের টাকা দিয়ে মালয়শিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে।’

এ পরিস্থিতি অস্ট্রেলিয়ার জন্য একটি সংকট উপস্থাপন করতে পারে। বাংলাদেশে আসার পর থেকে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার একটি বিপ–ল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অসাধারণ ধৈর্য দেখিয়েছে। অল্পসংখ্যক মানুষ ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছে। কিন্তু এ গন্তব্যগুলো এখন বেশ দুর্গম। ভারত তার সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে। থ্যাইল্যন্ডে যাওয়ার স্থলপথ যুদ্ধের কারণে কেটে গেছে। আর মালয়েশিয়া তো নৌকাগুলোকে ভিড়তেই দিচ্ছে না।

গত কয়েক সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের দিকে রওনা হয়েছে শরণার্থীরা। এটি সমুদ্রপথে পালানোর নতুন কার্যকর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত মাসে অন্তত ছয়টি নৌকা চলে গেছে এবং প্রায় ৪০০ লোক নিয়ে দুটি নৌকা এখন আন্দামান সাগরে বেড়াচ্ছে। পাচারকারীরা একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গঠনের মাধ্যমে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। আজকাল তারা অনেক বড় বড় নৌকা ব্যবহার করছে। ধারণক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার খরচও কমে গেছে। কক্সবাজারে জাতিসংঘের সূত্র অনুসারে, আগে জনপ্রতি চার লাখ টাকার (পাঁচ হাজার ৫০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার) পরিবর্তে এখন খরচ হচ্ছে মাত্র দুই লাখ টাকা (দুই হাজার ৮০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার)।

এত টাকা খরচ করেও কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের একটা বর্বর সমুদ্রযাত্রা সহ্য করতে হয়। এসব নৌকায় প্রায়ই খাবার, পানি ও জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। যাত্রার মাঝপথে বিকল হয় ইঞ্জিন। ধর্ষণ তো আছেই।

বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ শরণার্থী পালানোর ব্যাপারটি দেখেও দেখছে না। আগে ভারতীয় নৌবাহিনী এসব নৌযানকে মেরামত ও জ্বালানি সহায়তা দিয়েছে। এমনকি ইঞ্জিন মেরামতেও সাহায্য করেছে, যাতে জাহাজগুলোকে ভারতীয় সীমানার কোনো দ্বীপে থামতে না হয়। অতীতেও অস্ট্রেলিয়া শরণার্থীদের গন্তব্য ছিল। আবারও তেমনই হবে যদি ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ এভাবে নৌকা সমুদ্রে ঠেলে দেয়া চালু রাখে। সমুদ্রপথে আরও শরণার্থীর আগমন আলবেনিজ সরকারের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত সম্প্রতি আটকে রাখা উদ্বাস্তুদের মুক্তিকে ঘিরে বিতর্কের কারণে।

আগামী তিন মাস সমুদ্রে শান্ত আবহাওয়া বিরাজ করবে। এই সুযোগে অস্ট্রেলিয়াকে দ্রুত কাজ করতে হবে যাতে এদিকে নতুন একটি পালানোর সমুদ্রপথ তৈরি না হয়। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার জোর দিতে হবে যাতে উৎসে প্রস্থান বন্ধ করা যায়।

বিগত ১০ বছরে অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কার সামুদ্রিক নিরাপত্তা সক্ষমতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদানসহ শ্রীলঙ্কা সরকারের সঙ্গে সফলভাবে কাজ করেছে। বিনিময়ে শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণভাবে না হলেও সামুদ্রিক প্রস্থান বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই কৌশল কাজ করবে, এমনটা ভাবার কারণ কাছে। এর জন্য প্রয়োজন কেবল দুটি পদক্ষেপের। প্রথমত, অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করতে হবে। দেশটির উপকূলীয় জলসীমায় আইন প্রয়োগের প্রধান দায়িত্ব রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু মাত্র কয়েকটি সমুদ্রগামী জাহাজ ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব থাকায় এ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা খুবই কম।

বাংলাদেশ কোস্টগার্ডকে উপযুক্ত উপকরণ সরবরাহ করা হলে শুধু মানুষ চোরাচালানই নয়, অবৈধ মাছ ধরা ও মাদক চোরাচালানের মতো অন্যান্য সমস্যাও দূর হবে। প্রতিবেশি শ্রীলঙ্কার মতোই অস্ট্রেলিয়াকে নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশকে তার নিজস্ব সামুদ্রিক অঞ্চলগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করতে হবে। এতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সমুদ্রপথে উদ্বাস্তুদের পালিয়ে যাওয়া রোধে কাজ করতে উৎসাহিত করবে।

দ্বিতীয়ত, যে ব্যাপারগুলো রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করছে, তা দূর করতে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে মানবিক সহায়তা বাড়াতে হতে পারে। অস্ট্রেলিয়া এরই মধ্যে অনেক কিছু করেছে। কিন্তু ক্যাম্পগুলোয় ক্রমাগত সংকট বৃদ্ধির কারণে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর যথেষ্ট প্রভাব পড়তে পারে।

সমুদ্রেপথে জনসংখ্যার বাস্তুচ্যুতি রোধে অস্ট্রেলিয়ার হাতে এরই মধ্যে একটি সফল মডেল রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবার সুবিধার জন্যই এখন এ শিক্ষা বাংলাদেশে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

ডেভিড ব্রিউস্টার

গবেষক, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

দি ইন্টারপ্রিটার থেকে ভাষান্তর শামসুন নাহার রাখী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০