বৈশ্বিক সম্পদ অপচয় রোধে মেটাভার্স প্রযুক্তি

নুসরাত জাহান পন্নি: অভাবের তুলনায় পৃথিবীর সম্পদ সীমিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে থাকা সম্পদ শেষ হতে চলেছে। নতুন সম্পদের খোঁজে আমরা সাধারণত মাটি খুঁড়ে প্রয়োজনীয় পদার্থ বের করে আনি। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে নিয়ে যাই, গলাই, একত্রিত করি এবং পরীক্ষা করে দেখি তা কাজ করে কিনা। যদি না করে তাহলে আরও খনন করি। আবার চেষ্টা করি। মোট কথা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একটা জিনিস আমরা সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হই। আর এসবের পেছনে আমাদের অনেক সময় ব্যয় হয়। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, অনেক অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যয় হয়।

কিন্তু কেমন হয় যদি আমরা এই কাজগুলো ডিজিটাল পৃথিবীতে সম্পন্ন করি? কোনো কাজ শুরু করার আগেই তা ডিজিটাল পৃথিবীতে পরখ করি? এই প্রযুক্তিকে বলা হয়, মেটাভার্স প্রযুক্তি। এটি এমন একটি ভার্চুয়াল-রিয়েলিটি স্পেস, যেখানে ব্যবহারকারীরা কম্পিউটার-উৎপাদিত পরিবেশ এবং অন্যান্য ব্যবহারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।

আমাদের চেনা পৃথিবী থেকে ডিজিটাল পৃথিবীর ধারণাটা একটু ভিন্ন। সেখানে আমরা চাইলেই একটি ডিজিটাল খেলার মাঠ তৈরি করতে পারি। আবার পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন কঠিন নিয়ম-কানুনের চিন্তা না করে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এমনকি, সত্যিকারের পৃথিবীর একটি প্রতিরূপ তৈরি করে তাতে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট শুরু করতে পারি। সিয়েমেন্স এজির ম্যানেজিং বোর্ডের সদস্য এবং ডিজিটাল ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির সিইও সেডরিক নিকের মতে, মেটাভার্স প্রযুক্তির দরুন আমরা যে কোনো বিষয় দ্বিগুণ নয়, দশগুণ নয়, বরং লক্ষগুণ বা তার চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি শিখতে পারি। এজন্য আমাদের শুধু খেয়াল রাখতে হবে যে, কোন সমস্যার প্রতি আমরা কতটা কারিগরি সক্ষমতা প্রয়োগ করছি।

এবার আসা যাক এই প্রযুক্তির প্রায়োগিক দিকে। বর্তমানে আমরা অনেক বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছি। এছাড়া যথেষ্ট নবায়নযোগ্য শক্তিও ব্যবহার করছি না। আর আমরা এটাও জানি যে, নবায়নযোগ্য শক্তির মধ্যে ব্যাটারি সবচেয়ে জনপ্রিয়। কিন্তু ব্যাটারির একটা সমস্যা হলো ব্যাটারি উৎপাদনে বর্তমানে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। ২০১৯ সাল থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার ব্যাটারি উৎপাদনে বিনিয়োগ করা হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ব্যাটারি তৈরি করার জন্য ২০০টি গিগাফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হয়েছে। আর এক একটা গিগাফ্যাক্টরির আয়তন দুটি সমান্তরালভাবে রাখা আইফেল টাওয়ারের সমান। তাহলে একবার চিন্তা করে দেখুন ২০০টি এরকম আকারের গিগাফ্যাক্টরি ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীর ব্যাটারির চাহিদা পূরণ করার জন্য। শুধু এখানেই শেষ না। এই ফ্যাক্টরিগুলোতে একেবারে সঠিক ব্যাটারি সঠিক পদ্ধতিতে তৈরি করতে এবং রিসাইকেল করতে হয়। এর মানে হল, সামান্য একটু এদিক সেদিক হলে বা সামান্য কোনো ভুল হলে সেদিনের বা কয়েক দিনের উৎপাদিত ব্যাটারি একেবারে বাতিল হয়ে যায়। এতে দেখা যাচ্ছে, প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় হয়।

তাহলে মেটাভার্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে কি আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি? পারলে সেটা কীভাবে? উত্তরটা খুবই সহজ। এর জন্য আমাদের আগে একটি ডিজিটাল ফ্যাক্টরি তৈরি করতে হবে। সেখানে আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে একদম পারফেক্ট ব্যাটারি তৈরি করব, এক্সপেরিমেন্ট করব যে কীভাবে এটা করা উচিত, কী কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি তা পর্যবেক্ষণ করব, তারপর সেই সমস্যার সমাধান করব। যেমন গাড়ির ব্যাটারির দিকেই তাকানো যাক। যদি আমরা এই ব্যাটারিকে ৩০% দ্রুত ঠাণ্ডা করতে পারি তাহলে সেই গাড়িকে দ্বিগুণ তাড়াতাড়ি চার্জ করা যাবে। এতে দেখা যাচ্ছে, আমরা এখানে কম সম্পদ ব্যয় করে অনেকটা সময় বাঁচাতে পারছি।

এই প্রযুক্তির সাহায্যে সত্যিকারের ফ্যাক্টরির সঙ্গে সঙ্গে একটি ডিজিটাল ফ্যাক্টরিও সমানভাবে চলছে। যার ফলে উৎপাদন সংক্রান্ত যেকোনো বিষয় খুব দ্রুত আয়ত্ত করা সম্ভব হচ্ছে।

এ তো গেল ডিজিটাল ব্যাটারি তৈরির ধাপ। এরপর সেটাকে বাস্তবতায় রূপ দেয়ার পালা। এরপর আসে রিসাইকেল করার ব্যাপার। মজার ব্যাপার হলো, ২০টি ব্যাটারি রিসাইকেল করতে দিলে মাত্র একটা ব্যাটারি শেষ পর্যন্ত রিসাইকেল করা হয়। বাকি ১৯টাই ফেলে দেয়া হয়। ডিজিটাল ফ্যাক্টরি থাকার আরেকটা সুবিধা হলো, প্রতিটা বাস্তব ব্যাটারির একটি ডিজিটাল ভার্সন থাকবে। যার ফলে যেকোনো ব্যাটারির স্বতন্ত্র পরিচয়, উৎপাদন সম্পর্কিত বিবরণ, উপাদান, মেরামত পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। আর এই প্রযুক্তি অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় করার মাধ্যমে আমরা ৯৫ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি ব্যাটারিকে আবারও ব্যবহারযোগ্য করতে পারব। শুধু ব্যাটারিই না, যেহেতু এই প্রযুক্তিতে ক্লাউড কম্পিউটিং এবং এআই ব্যবহার করা হয়, তাই যে কোনো শিল্পে এ প্রযুক্তি ব্যবহারযোগ্য।

অনেক শিল্পে ইতোমধ্যেই মেটাভার্স প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন, বিমান শিল্প। বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইডের তিন থেকে চার শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। ইদানীং বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ইলেকট্রিক্যাল প্লেন তৈরি করছে। আর এক্ষেত্রে প্রথমেই তারা মেটাভার্স প্রযুক্তি ব্যবহার করছে সেগুলো দক্ষভাবে তৈরি করার জন্য।

আরেকটা উদাহরণ হলো খাদ্যশিল্প। বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইডের ২৫% আসে কৃষি খাত থেকে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খাদ্য উৎপাদনের জন্য গিগাফ্যাক্টরি তৈরি করতে পারি যা হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। যেই খামার ১০০% নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করবে, ৯৫% কম পানি ব্যবহার করবে, এমনকি ০% কীটনাশক ব্যবহার করবে। আর এই খামারের উৎপাদিত খাদ্যের মান এবং স্বাদ দুটোই হবে বেশ ভালো।

আরও একটি উদাহরণ হলো অবকাঠামো শিল্প। আমাদের বৈশ্বিক ৩০% এনার্জি এই খাতে ব্যয় হয়। আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও উন্নত অবকাঠামো ডিজাইন করতে পারি। শুধু দুই-একটা ভবন নয়; বরং পুরো শহরকে আমরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাজাতে পারি, যা হবে আরও টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং কম শক্তি অপচয়কারী। আগে থেকেই ডিজাইন করতে পারি যে, অতিরিক্ত তাপ কোথায় যায়, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা কোথায় যাচ্ছে, বৃষ্টি হলে কী হতে পারে, সেখানকার জীবজগৎ কেমন হবে, জীববৈচিত্র্য কেমন হবে, হুইলচেয়ার সুবিধা থাকবে কিনা ইত্যাদি সবকিছু আগে থেকেই ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে মেটাভার্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।

এ ধরনের উদাহরণ আরও অনেক দেখা যায়। কিন্তু সিংহভাগ শিল্পই এখনও এই শিল্প আয়ত্ত এবং ব্যবহার করে উঠতে পারেনি। কিন্তু, সব ধরনের শিল্প যদি এই প্রযুক্তি গ্রহণ করে তাহলে আমরা বৈশ্বিক অনেক সম্পদ অপচয় না করে সংরক্ষণ করতে পারব আর তার যথাযথ ব্যবহার করতে পারব। যত তাড়াতাড়ি আমরা এই ধরনের প্রযুক্তি আরও প্রয়োগ করতে পারব তত দ্রুত আমরা একটি সুন্দর পৃথিবী আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দিতে পারব।

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০