সাইশা সুলতানা সাদিয়া: বর্তমানে আমাদের দেশের মাথাপিছু জিডিপি দুই হাজার ৬৮৭ মার্কিন ডলার। এটা শুধু সরকারিভাবে হিসাবকৃত খাতগুলো থেকে তুলে আনা জিডিপির পরিমাণ। কিন্তু এমন অনেক খাত আছে, যেগুলো তথ্যের অভাবে বা অবৈধ হওয়ার কারণে সরকারি হিসাবে আসে না। এই খাতগুলোর আয় জিডিপিতে যুক্তও হয় না। ফলে জিডিপির পরিমাণ কম দেখায়। এই হিসাব-বহির্ভূত খাতগুলোকে বলা হয় গ্রে ইকোনমিক সেক্টর বা ধূসর অর্থনৈতিক খাত। গ্রে ইকোনমির অন্তর্ভুক্ত যেকোনো অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, যা আইনি কিন্তু নথিভুক্ত নয় এবং অনিয়ন্ত্রিত। এর লেনদেনগুলো প্রায়ই সালিশের সুযোগগুলোকে জড়িত করে সেরে ফেলা হয়। ফলে এসব লেনদেন সরকারি পরিসংখ্যানের রেকর্ড করা যায় না। আরও সহজ করে বলতে গেলে গ্রে ইকোনমি হলো এমন আয়ের খাতসমূহ, যেগুলো অবৈধ বা যার ওপর কর আরোপ করা হয় না বা সরকারের হিসেবে আসেনি। অবৈধ খাতসমূহ তথা আয়ের মাধ্যমগুলো মূলত মানব পাচার, মাদক ব্যবসা, জুয়া, চোরাকারবারি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দুর্নীতি, ঘুষ, পতিতাবৃত্তি, অবৈধ কমিশন, টেন্ডারবাজি, অর্থপাচার, জালিয়াতি, অস্ত্র পাচার, সাইবার ক্রাইম, হ্যাকিং, ঋণখেলাপি প্রভৃতি। সরকারের হিসেবে না আসা আরও আয়ের মাধ্যম হলো বাসার ছাদে বা ঘরের উঠানে শাকসবজি চাষ, ফলমূলের চাষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর আয়, ফুটপাতের হকারদের আয়, গৃহকর্মীর আয় প্রভৃতি।
জরিপে দেখা যায়, গ্রে ইকোনোমিক খাতগুলোয় বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ জনসংখ্যা কাজ করে। এটি মোট অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ২০ শতাংশ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রে ইকোনমি আমাদের জিডিপির ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সার্বিক তথ্যের অভাবে এবং নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে এই খাতসমূহের আয় জিডিপিতে আসে না। এখানে উল্লেখ্য, তার মানে এই নয় যে অবৈধ খাতসমূহকে স্বীকৃতি দিয়ে বা বৈধ করে আয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে কঠোর আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে অবৈধ আয়সমূহের পথ বন্ধ করে দিতে হবে। পাশপাশি এসব খাতে জড়িত ব্যক্তিদের বৈধ খাতে নিয়োজিত করতে পারলে সেই আয় জিডিপিতে যুক্ত করা সম্ভব হবে। কেননা গবেষণা বলে, গ্রে ইকোনমিক খাতগুলোর আয়ের হিসাব যুক্ত করতে পারলে মাথাপিছু জিডিপি হতো চার হাজার ৯২১ মার্কিন ডলার।
এবার গ্রে ইকোনমি সৃষ্টির পেছনে কারণ জানা যাক। দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয়কে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাছাড়া অপরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা অতিরিক্ত কর আরোপও বিশেষ কারণ। আর্থিক খাতের অস্বচ্ছতা ও অপ্রাসঙ্গিক নিয়মকানুন প্রয়োগের কারণেও গ্রে ইকোনমির আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত বাণিজ্যিক নিয়মকানুন চাপ সৃষ্টি করলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অনৈতিক খাতসমূহে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কর্তৃপক্ষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং নথিভুক্ত করার অদক্ষতা ও উদাসীনতা, ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা, প্রান্তিক পর্যায়ের অঞ্চলসমূহের আয়গুলো লিপিবদ্ধ করার কার্যকর পদ্ধতি না থাকা বা কোনো পদ্ধতিই না থাকা, আইনগত সীমাবদ্ধতা ও অসংগতি, হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ঘনঘন আইনের পরিবর্তন, হিসাব পদ্ধতির দুর্বলতা, আয়ের অসম বণ্টন, সর্বোপরি আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে গ্রে ইকোনমিক আকার বৃদ্ধি পায়। এসব অসংগতির কারণে প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র জানা যায় না। ফলে নীতি প্রণয়ন হয় ত্রুটিপূর্ণ। প্রকৃত পরিস্থিতি ধোঁয়াশায় থাকার কারণে দারিদ্র্য ও বেকারত্বকেও সঠিক সংখ্যার কাঠামোয় উপস্থাপন করা যায় না।
অবৈধ আয়ের খাতগুলোর সঙ্গে জড়িত হওয়ার ফলে সমাজে অপরাধ বেড়ে যাবে এবং উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে অনেকে নিয়ম মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করে, কিন্তু নিয়ম ভঙ্গকারীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এসব বৈষম্যের ফলে সৎ লোক পিছিয়ে পড়ে, অসৎ লোক সুযোগ পায়। এমনকি কর বাড়ানোর ফলে সৎ লোকের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে, ফাঁকিবাজ ও দুর্নীতিবাজরা উদাসীন হয়ে বেঁচে যায়। এভাবে অবৈধ আয়ে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে জমিজমা ও অন্যান্য সম্পদের মূল্য স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। শেয়ার মার্কেটের বড় একটা অংশও তাদের দখলে। তারা ইচ্ছামতো শেয়ার মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করছে।
তবে এখানে একটু স্বস্তির বিষয় হলো, গ্রে ইকোনমির মাধ্যমে যে হিসাব-বহির্ভূত কর্মসংস্থান হয় তাতে পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রে জনগণ উপকৃতও হয়। কিন্তু যেখানে ক্ষতির দিক বেশি, সেখানে এত কম পরিমাণ লাভকে ত্যাগ করাই শ্রেয়।
বাংলাদেশে সম্পদ পাচারকারীরা বিদেশের সম্পদ কেনা, শেয়ার মার্কেটে, জমি, স্বর্ণ-অলংকার লেনদেন প্রভৃতি ক্ষেত্রে গ্রে ইকোনমির সুযোগ নেয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে গ্রে ইকোনমির আকার তুলনামূলকভাবে বড় হয়। উন্নত বিশ্বের আকার প্রায় সাত শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হতে পারে। গ্রে ইকোনমির বিস্তারের ফলে দেশের উন্নতি, অগ্রগতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এবং আমাদের সমাজজীবনে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে খারাপ প্রভাবই অধিক পরিলক্ষিত হয়। বাস্তবতা হলো, এ ধরনের অর্থনৈতিক খাতগুলোকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হলে আশা করা যায় সুফল পাওয়া যাবে। আইনের সুশাসন, নৈতিকতা লালন ও আর্থিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রে ইকোনোমির আকার হ্রাস করা সম্ভব। তবেই আমরা ক্রমবর্ধমান জিডিপি অর্জনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ অর্থনীতির সচ্ছল রাষ্ট্র গঠন করতে পারব।
শিক্ষার্থী
ইসলামিক স্টাডিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়