আজকাল পত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের খবর বেশি আসছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিবাহবিচ্ছেদ যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। সাধারণ দম্পতি থেকে শুরু করে বাদ যাচ্ছেন না তাড়কাখ্যাত দম্পতিরাও। এ থেকেই প্রমাণিত হয় বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনের জন্য অর্থবিত্ত কিংবা রূপ-সৌন্দর্য ছাপিয়ে দরকার আরও বেশি কিছুর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২২’ শীর্ষক জরিপে উঠে আসে, ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে একটি তালাক হচ্ছে। কী ভয়াবহ! এক জরিপে দেখা গেছে, ৭০ দশমিক ৮৫ শতাংশ তালাক গ্রহণ করছেন নারী আর ২৯ দশমিক ১৫ শতাংশ তালাক দিচ্ছেন পুরুষ।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো খতিয়ে দেখলে উঠে আসে নানা কারণ। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মূল্যবোধের অভাব, ছাড় না দেয়ার মানসিকতা এবং পারস্পরিক মতামত বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করা বিচ্ছেদের প্রাথমিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাছাড়া বর্তমানে নারীদের কর্মক্ষেত্রের বিস্তার ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকেও বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। সে হিসেবে শিক্ষিত সমাজে এবং গ্রামের চেয়ে শহরে বিচ্ছেদের হার বেশি হয়ে থাকে।
আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীরা অসম্মান, নির্যাতন ও মানসিক পীড়ন থেকে আলাদা থাকাকে ভালো মনে করছেন এবং বিচ্ছেদেই মুক্তি খুঁজছেন। বিশেষ করে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাসম্পন্ন নারীরা প্রাচীন কালের নারীদের মতো স্বামীর অসম্মান, হেয় করা ও শ্বশুড়বাড়ির কটু কথা সহ্য করতে মোটেও পছন্দ করেন না। বলা বাহুল্য, তা সমীচীনও নয়। স্বামী-স্ত্রী উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ক্যারিয়ারে অতি মনোযোগ দেয়ার কারণে সংসারে সময় কম দিচ্ছেন, অফিসের কাজ বাসায় রাখছেন, কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ দিনগুলোয় মিটিং রাখছেন। এগুলো সম্পর্কে চির ধরতে সাহায্য করে।
তাছাড়া প্রযুক্তির উপকারিতা সংসারে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাইরের দেশের টিভি সিরিয়ালগুলোয় দম্পতিদের জীবন অনেক বর্ণিল দেখানো হলেও বাস্তব জীবন রঙিন নয়। আবার ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে হ্যাপি কাপলের পোস্ট বা স্টোরি দেখেও তুলনা করেন নিজের দাম্পত্য জীবনের। ফলে অনেকেই নিজের বৈবাহিক জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝামেলা শুরু হয় তখন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরস্পরকে সময় কম দেয়ায় যে পরকীয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, তাতেও বিবাহবিচ্ছেদে রূপ নিতে বেশি সময় লাগে না।
যদিও অস্বাস্থ্যকর ও লোকদেখানো দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে বের হওয়াই সমীচীন। কিন্তু নর-নারীর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একসঙ্গে থাকার জন্য যে বিবাহবন্ধনের সৃষ্টি, সেখানে বিবাহবিচ্ছেদ কে চায়! বিচ্ছেদ কথাটা ছোট হলেও ব্যাপারটা এত সহজ নয়। এর সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এবং ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। এক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান বজায় রাখা জরুরি। পারস্পরিক ভালোবাসা বাড়াতে স্বামী-স্ত্রীকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে পারেন, কিংবা কাজ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। সবচেয়ে বেশি জরুরি, ছোটখাটো ঝামেলাগুলো স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই যেন মিটিয়ে ফেলেন। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আচরণও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ই স্ত্রীকে নিচু দেখানো বা হেয় প্রতিপন্ন করার মধ্যে স্বামীর অধিকার রয়েছে বলে সমাজে ধারণা আছে।
একজন মেয়েই পারেন সর্বংসহা হয়ে সংসার টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু টিকিয়ে রাখার দায় যদি একজনের ওপর বর্তায়, তা হবে খুবই দুঃখজনক। দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ব্যক্তির সবকিছুই আলাদা হবে স্বাভাবিকভাবেই। সেক্ষেত্রে সম্মানবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিলেই গড়ে তোলা যায় সুখের নীড়। ভালোবাসা সৃষ্টিকর্তার দান। দাম্পত্য জীবনে দুজনের বোঝাপড়ার মধ্যেই ধরাকে স্বর্গে রূপান্তর করা যায়। আর এই সম্পর্ক হলো গাছের মতো, যাকে প্রতিদিন পানি দিয়ে যত্ন করতে হয়। আর সে গাছে পানি ঢালতে হবে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই।
মহিমা ইসলাম রিমি
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়