মাইক্রোম্যানেজমেন্ট: বৃহৎ পরিসরে সমস্যাই বেশি

টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ: মাইক্রোম্যানেজমেন্ট হলো একটি ব্যবস্থাপনা শৈলী বা কৌশল বা উপায় যেখানে একজন ব্যবস্থাপক অধস্থন বা কর্মচারীদের কাজ বেশি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণ করে। ছোট পরিসরে এর কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও সামগ্রিক ও বৃহৎ পরিসরে মাইক্রোম্যানেজমেন্টের সাধারণত একটি নেতিবাচক অর্থ থাকে। বাস্তবে, আমাদের সবার কাছে এটি হচ্ছেÑ অধীনস্থ কর্মীদের সব কাজেই অতিরিক্ত খবরদারি বা নাক গলানো। এই ধরনের ব্যবস্থাপনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহকে বিঘ্নিত করে।

তাহলে এখন প্রশ্ন হলো মানুষ মাইক্রোম্যানেজমেন্ট কেন করে? মাইক্রোম্যানেজিং হলো ব্যবস্থাপনার একটি উপায়, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে কাজগুলো খুব সুনির্দিষ্টভাবে সম্পাদিত হয়। সমস্যা হলো এটা সবসময় সঠিক বা সবচেয়ে উৎপাদনশীল বা সব্বর্ত্তম উপায় নয় এবং ব্যবস্থাপনার অন্যতম সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে মাইক্রোম্যানেজমেন্ট। এই ব্যবস্থাপনা শৈলীর সঙ্গে আসা অন্যান্য কিছু সমস্যার দিকে নজর দেয়া যাক এবং কেন এটি এড়ানো উচিত।

নিয়ন্ত্রণ হারানো: যখন কর্মীদের মাইক্রোম্যানেজ করা হয়, তখন সিনিয়রের হাতে যেসব ম্যানেজমেন্ট টুলস আছে তার দ্বারা নিজেকে সীমাবদ্ধ করে যতক্ষণ না তার নাগালে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ না আসে। তখন নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে মজার বিষয় হয়ে যায় যে, এটিই পরিচালনার ক্ষেত্রে সিনিয়রের একমাত্র টুলস বা উপায়। টিমকে মাইক্রোম্যানেজ করার চেষ্টা করার কারণে ব্যবসার প্রবৃদ্ধির জন্য সময় ব্যয় করার পরিবর্তে মাইক্রোম্যানেজের কাজে সময় বেশি ব্যয় হয়।

এটা উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ যে, অনেকগুলো ভালো ব্যবস্থাপনা শৈলী রয়েছে যেগুলো অনুসরণ করলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অনেক বেশি কাজে উৎসাহিত হবে এবং ব্যবসার প্রসার লাভ ঘটবে। যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মী ব্যবস্থাপনাকে মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তখন নিজের অজান্তেই অন্যান্য দিকে সিনিয়রের যোগাযোগ করার ক্ষমতা এবং শেষ পর্যন্ত পরিচালনা করার ক্ষমতাকেও সীমিত হয়ে যায়।

বিশ্বাস হারানো: মাইক্রোম্যানেজমেন্ট শেষ পর্যন্ত সিনিয়র এবং কর্মীদের বিশ্বাসের মধ্যে ব্যাপক ভাঙনের দিকে পরিচালিত করে। কর্মীরা তখন তার সিনিয়রকে একজন ম্যানেজার হিসাবে না দেখে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে দেখবে। সিনিয়রের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে প্রাচীর হিসেবে দাঁড়ায় মাইক্রোম্যানেজমেন্ট। এর ফলে কর্মী এবং ব্যবস্থাপকের মধ্যে ইতোমধ্যে বিদ্যমান বিশ্বাসের সম্পর্ককে নষ্ট করে।

বিশ্বাস চলে গেলে দুটি জিনিস ঘটতে পারে: উৎপাদনশীলতার মারাত্মক ক্ষতি এবং কর্মীদের কাজ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিরক্তি বা অনীহা। হ্যাঁ, পরেরটি একটি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি, তবে এটি ঘটে থাকে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বাস একটি দ্বিমুখী রাস্তা। কর্মীরা অবশ্যই সিনিয়রকে ততটা বিশ্বাস করতে সক্ষম হবেন যতটা সিনিয়র তাদের বিশ্বাস করে। মোদ্দাকথা মাইক্রোম্যানেজমেন্ট আস্থা নষ্ট করে।

নির্ভরশীল কর্মচারী: মাইক্রোম্যানেজ হওয়ার পরে, কর্মীরা নিজেরাই কাজ সম্পাদন করার আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তে সিনিয়রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে শুরু করবে। মাইক্রোম্যানেজমেন্টের ফলে কর্মীরা সবসময় এটা মনে করবে যে তাদের প্রতিটি কাজে অবশ্যই সিনিয়রের নির্দেশনা থাকবে। নির্ভরশীল কর্মীরা পরিচালনা করতে বেশি সময় এবং প্রচেষ্টা নেয়, যা কাজের সময়সূচি এবং শারীরিক ও মানসিক এনার্জির ওপর প্রভাব ফেলে। মনে রাখতে হবে যে এই কর্মচারীদের প্রাথমিকভাবে নিয়োগ করা হয়েছিল, কারণ তারা কিছু যোগ্যতা নিয়ে এসেছে: যেমন দক্ষতা, প্রতিভা এবং দূরদৃষ্টি। যখন কর্মচারীরা সিনিয়রের ওপর কম নির্ভরশীল হয় বা স্বাধীনভাবে কাজ করতে থাকে, তখন তারা নিজেরাই চিন্তা করতে থাকবে এবং যখন কর্মচারীদের নিজেদের চিন্তা করার স্বাধীনতা থাকে, তখন দারুণ ইতিবাচক কিছু ঘটতে পারে।

সিনিয়র যদি খুব বেশি মাইক্রোম্যানেজ করে, তাহলে কর্মীদের দক্ষতা, প্রতিভা এবং দূরদৃষ্টিগুলো কমে যেতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানে এমন একটি দলের সঙ্গে রেখে যেতে পারে, যারা কেবল যা বলা হয়েছে, তা কীভাবে করতে হয় শুধু তা-ই জানে। অনেকটা ‘জো-হুকুম জাহাপনা’ টাইপের। সিনিয়রকে অবশ্যই কর্মীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং কাজ করার অনুমতি দিতে হবে।

ম্যানেজার বার্নআউট: মাইক্রোম্যানেজিং একেবারে ক্লান্তিকর একটি পন্থা। প্রতিদিন এত কর্মীর দিকে তাকানো খুব দ্রুত সিনিয়রকে অতিরিক্ত কাজের চাপে ফেলবে। অবশেষে অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে চাকরির প্রতি একসময় অনীহা আসতে শুরু করবে। যদি কাজের প্রতি যথেষ্ট অনীহা চলে আসে তবে সিনিয়র নিজেও কাজ বা চাকরি ছেড়ে যেতে পারে এবং এমনও হতে পারে যে, কখনও হয়তো এধরনের পরিচালনার ভূমিকায় নিজেকে আবার দেখতে চাইবে না।

অবশ্যই বার্নআউট যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে সর্বদা একটি বিপদ। তবে মাইক্রোম্যানেজিংয়ের সময় যে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের শক্তি ক্ষয় হয়, তা অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি। বার্নআউটের এই অনুভূতি শুধু কর্মজীবনকে প্রভাবিত করে না, পারিবারিক জীবনেও প্রসারিত হতে পারে এবং এমনকি উদ্বেগ ও হতাশার কারণও হতে পারে। ভুলে যাওয়া যাবে না যে, শুধু ম্যানেজাররাই যে বার্নআউট হয় তা নয়, তাদের নিচের লোকদের মধ্যেও তা সংক্রমিত করতে পারে। মাইক্রোম্যানেজমেন্ট শুধু সিনিয়র বস ও কর্মীদের জন্যই খারাপ নয়, তবে এটি সবারই শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে।

কর্মীদের উচ্চ টার্নওভার: সহজ কথায় বেশিরভাগ মানুষ মাইক্রোম্যানেজমেন্ট পদ্ধতিকে ভালোভাবে নেয় না। যখন কর্মীদের মাইক্রোম্যানেজ করা হয়, তখন তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি কাজই করে, তা হলো নতুন চাকরি খুঁজে চলে যায়। ম্যানেজাররা মাইক্রোম্যানেজ করে যেসব কারণে সেগুলো হচ্ছেÑ ইগো, নিরাপত্তাহীনতা, অনভিজ্ঞতা, নিখুঁততাবাদ, অহংকার ইত্যাদি। যার ফলে ঘটে কর্মীদের উচ্চ টার্নওভার। ক্রমাগত কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং আবার প্রশিক্ষিত করার ফলে শুধু কাজের গতিই মন্থর ও ছন্দহীন হয় না, এটি প্রতিষ্ঠানকে কম যোগ্য লোকদের জন্য একটি অভয়ারণ্য হিসেবে তৈরি করে। যার ফলে প্রতিষ্ঠান হারায় দক্ষ, যোগ্য, সৃজনশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মীদের। মাইক্রোম্যানেজমেন্টের কারণে অনেক বেশি হারে ভালো কর্মীরা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে।

এম্পাওয়ারমেন্টের অভাব: যখন কোনো ম্যানেজার মাইক্রোম্যানেজ করেন, তখন কর্মীরা মনে করতে শুরু করে যে তারা তাদের এম্পাওয়ারমেন্ট হারাচ্ছে। যখন এটি ঘটবে তখন তারা ধীরে ধীরে ম্যানেজার যা চান তা ছাড়া আর কিছু করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলবে। কেউ ছক বা বক্সের বাইরে পা রাখবে না অথবা একটি কাজের জন্য নিজে থেকে একটু বেশি করে কাজ বা চিন্তা বা মেধা খরচ করতে চায় না। সেই একই লোকদের যদি একটি নির্দিষ্ট লেভেলে এম্পাওয়ারমেন্ট দেয়া হয় এবং তারা তখন প্রতিষ্ঠানের জন্য এমন অনেক কিছু করবে, যা দেখে ম্যানেজার নিজেও সেসব কর্মীর জন্য গর্বিত হবেন। এম্পাওয়ারমেন্টের অভাব আপনার কর্মীদের সামগ্রিক অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারে।

উদ্ভাবনের অভাব: মাইক্রোম্যানেজিংয়ের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো কর্মীদের সৃজনশীল চেতনাকে বাধাগ্রস্ত করা। টিম মেম্বাররা যখন কোনো কাজ বা প্রজেক্টে কাজ করে, তারা তাদের এনালাইসিস বা অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পারে সেখানে কী ঘটছে বা ঘটবে। এমনও হতে পারে তা অন্য কারও চেয়েও ভালো। তখন তারা যদি কিছু উদ্ভাবন সামনে নিয়ে আসে, তা হয়তো সবসময় সফল নাও হতে পারে, তাও তাদের কাজের প্রতি সাপোর্ট দেয়া বা ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করা, যা তাদের পরবর্তী কাজকে অনেক অনুপ্রাণিত করবে। যদি তা না করে তাদের কোনো একটি ব্যর্থতাকে নেগেটিভ ভাবে দেখে এবং অবজ্ঞা করে, তার ফলে তাদের উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত বা চূর্ণ করা হয়। তখন ভালো ধারণাগুলো বেরিয়ে আসার এবং কাজ ভাগ করে নেয়ার সমস্ত সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। কর্মীরা তখন উদ্ভাবনে ঝুঁকি নিতে অস্বীকার করে। উদ্ভাবন হলো অগ্রগতির চাবিকাঠি। টিমকে মাইক্রোম্যানেজ করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টিম মেম্বারদের সৃজনশীলতা বা অগ্রগতির সুযোগ নষ্ট করে দেয়। এর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতির সম্ভাবনাকেও প্রত্যাখ্যান করা হয়।

যদি কোনো ম্যানেজার নিজেকে মাইক্রোম্যানেজিং ম্যানেজার হিসেবে খুঁজে পায়, তাহলে নিজেকে সংশোধন বা ঠিক করে নেয়া উত্তম। যাদের সঙ্গে কাজ করতে হয় তাদের প্রতি সিনিয়রের আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে কর্মীরা ক্রমাগত তদারকি ছাড়াই কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। কাজের স্বাধীনতায় কর্মীরা সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে নেবে।

হেড অব এইচ আর

স্টার সিরামিকস লিমিটেড

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০