কর পরিদর্শক হতে ইএসিটি পদোন্নতি ‘খামখেয়ালির’ জ্যেষ্ঠতা তালিকা

রহমত রহমান: ঢাকার একটি কর অঞ্চলে কর্মরত কর পরিদর্শক নাজমুন নাহার। তিনি ১৯৯৩ সালে ‘অফিস সহকারী’ হিসেবে যোগদান করেছেন। ১৯৭৫ সালে জন্ম হলেও তিনি ১৯৯৬ সালে বিএসএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০০২ সালে পদোন্নতি পেয়ে উচ্চমান সহকারী হয়েছেন। ২০১২ সালে প্রধান সহকারী আর ২০১৭ সালে হয়েছেন কর পরিদর্শক। ১৯৭৫ সালে জš§ হলেও তিনি ২০০১ সালে বিএসএস ডিগ্রি লাভ করেছেন। আর ২০০৫ সালে ‘উচ্চমান সহকারী’ হিসেবে যোগদান করেছেন সৈয়দ একেএম কুদরত-ই-রব্বানী। তিনি ২০১২ সালে প্রধান সহকারী হয়েছেন। ২০১৭ সালে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন কর পরিদর্শক। এনবিআর ২৭ ডিসেম্বর জ্যেষ্ঠতার যে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে নাজমুন নাহারের অবস্থান ১২৭। নাজমুন নাহার অফিস সহকারী হিসেবে যোগদান করেছেন।

আর সৈয়দ একেএম কুদরত-ই-রব্বানী অবস্থান ১২৮। তিনি যোগদান করেছেন উচ্চমান সহকারী হিসেবে। অথচ বিধিমালা অনুযায়ী, চাকরির প্রারম্ভিক পদ হিসেবে নাজমুন নাহারের আগে সৈয়দ একেএম কুদরত-ই-রব্বানীর অবস্থান থাকার কথা ছিল। অথচ যুক্তি দেয়া হলো যে, কর পরিদর্শক পদে যোগদানের তারিখ ও বয়স একই হওয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের শিক্ষাবর্ষের ভিত্তিতে পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু নাজমুন নাহার বা সৈয়দ একেএম কুদরত-ই-রব্বানী নয়, ২৭ ডিসেম্বর এনবিআরের প্রকাশিত চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু বিভাগীয় নয়, নন-ক্যাডারের ক্ষেত্রেও পিএসসি প্রণীত মেধাতালিকা অনুসরণ করা হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ২৭ ডিসেম্বর এনবিআর কর পরিদর্শক পদে কর্মরত ৮৩৩ জনের ‘চূড়ান্ত খসড়া জ্যেষ্ঠতার’ তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকাকে চরম বিতর্কিত ও খামখেয়ালি বলে উল্লেখ করেছেন কর পরিদর্শকরা। দ্বিতীয় সচিব (কর প্রশাসন-২) মো. জসিম উদ্দিন সই করা তালিকায় বলা হয়েছে, আয়কর বিভাগে কর পরিদর্শক পদে কর্মরত কর্মকর্তাদের পারস্পরিক চূড়ান্ত খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা, ২০২৩ প্রস্তুত করা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ২১ মে এনবিআর একটি খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রকাশ করেছিল। এরই অনুবৃত্তিক্রমে আবার ১০ কর্মদিবসের মধ্যে শুধু ‘নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা, ২০১১’-এর বিধি ৪-এর উপবিধি (২), বিধি ৭-এর উপবিধি (৩) ও (৪)-এর বিষয়ে আপত্তি থাকলে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছে।

দুটি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২১ মে সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা তালিকায় বিধি-৪ (১) (ক) (খ), বিধি-২, ৩ ও বিধি-৭-এর (১) (২) (৩) ও (৪) অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ২৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত তালিকায় বিধি-৪-এর (২), বিধি-৭-এর (৩) (৪) অনুসরণ করা হয়েছে। অজানা কারণেই বাকি উপবিধিগুলো বাদ দিয়েই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বেশিরভাগ পদোন্নতি বঞ্চিত হবেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। নন-ক্যাডার থেকে সরাসরি কর পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তরা কয়েকজন এই তালিকা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাদের দাবি জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিধি-৪-১-এর (ক, খ) মানা হয়নি। নন-ক্যাডার থেকে আগত কর পরিদর্শকদের এনবিআর থেকে যে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে। তাতে থাকা শর্তও জ্যেষ্ঠতা তালিকা করার ক্ষেত্রে মানা হয়নি। নিয়োগপত্রের ছ-তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক নির্ধারিত মেধাক্রম অনুযায়ী তার জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে। তথ্যমতে, নন-ক্যাডার ৩৪ ব্যাচ ২০১৭ সালে কর পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেন। তবে কয়েকজনের সমস্যা থাকায় তারা ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যোগদান করেছেন। কিন্তু সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা করায় তারা ৩৪ ব্যাচের সঙ্গে মেধাতালিকায় থাকতে পারেনি।

একাধিক কর পরিদর্শক শেয়ার বিজকে বলেছেন, চলতি বছরের মে মাসে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেটাকে আমরা ফিডার পদে যোগদানের ভিত্তিতে তৈরি করা বলেই জেনেছি। ২৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত তালিকার মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মে মাসে প্রকাশিত তালিকার অনুবৃত্তিক্রমে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা যারা পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর পরিদর্শক, তারা তিনটি পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে কর পরিদর্শক হয়েছি। সেই তিনটি পদ হলো ইউডি, গ্রাফার ও স্টেনো। এই তিনটি পদই ফিডার পদ। ২০১৬ সালে এনবিআর এই তিন গ্রুপের আলাদা গ্রেডেশন তৈরি করে। তার ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ ২৮৯ জন ইউডি, ২৯ জন গ্রাফার ও ১৩২ জন স্টেনোকে কর পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দিয়েছে। ২০১৬ সালে তিন গ্রুপের যে গ্রেডেশন চূড়ান্ত করেছে ২৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত তালিকায়, তা অনুসরণ করা হয়নি। এতে ২০১৬ সালের তালিকায় থাকা অনেক জুনিয়র সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকায় অনেক সিনিয়রের ওপরে অবস্থান করছেন।

এনবিআর সূত্রমতে, ‘কর পরিদর্শক (দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে পদোন্নতির জন্য তৃতীয় শ্রেণির বিভিন্ন পদের সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নের মতামত চেয়ে’ এনবিআর থেকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (কর প্রশাসন-২) মো. আব্দুর রাজ্জাক সই করা চিঠিতে বলা হয়, কর পরিদর্শক (দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে পদোন্নতির জন্য তৃতীয় শ্রেণির বিভিন্ন পদের সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নকালে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা, ২০১১-এর ৪(২) অনুচ্ছেদের বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ৪(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন পদের সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শ্রেণির প্রারম্ভিক পদে নিয়মিত যোগদানের তারিখের ভিত্তিতে সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে।’

চিঠিতে বলা হয়েছে, এনবিআরের অধীন আয়কর অনুবিভাগে অন্যান্য পদের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণির অফিস সহকারী, উচ্চমান সহকারী ও প্রধান সহকারীর পদ রয়েছে। নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৯৫ অনুযায়ী কর পরিদর্শক পদে পদোন্নতির জন্য ফিডার পদ হিসেবে উচ্চমান সহকারী ও প্রধান সহকারীর পদ রয়েছে, কিন্তু অফিস সহকারীর পদ নেই। এছাড়া উচ্চমান সহকারী পদে ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ ও ৫০ শতাংশ পদ অফিস সহকারী পদ হতে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণের বিধান রয়েছে। ফলে উচ্চমান সহকারীরা পদোন্নতি ও সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে নিয়োজিত আছেন। উল্লেখ্য, প্রধান সহকারীর পদটি শতভাগ উচ্চমান সহকারীর মধ্য হতে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণের বিধান রয়েছে। ফলে যেসব কর্মচারী অফিস সহকারী হতে পদোন্নতির মাধ্যমে উচ্চমান সহকারী বা প্রধান সহকারী পদে কর্মরত আছেন, তাদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে অফিস সহকারীর পদ নয়, উচ্চমান সহকারী পদে নিয়মিত যোগদানের তারিখ বিবেচিত হবে। এই বিষয়ে মতামত প্রয়োজন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মতামত দেয়, বিধি-৪(২) অনুচ্ছেদের বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া উচ্চমান সহকারী উভয়ের জন্য ‘উচ্চমান সহকারী পদকে প্রারম্ভিক পদ’ হিসেবে বিবেচনা করে সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিদর্শক শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, কর পরিদর্শকদের জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন নিয়ে কর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা স্মরণকালের সব সীমা ছাড়িয়েছে। ২১ মে প্রকাশিত তালিকায় যে কর পরিদর্শকের অবস্থান ছিল ১০২, সেই কর পরিদর্শক ২৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত তালিকায় ৬ নম্বরে অবস্থান করছেন। তিনি কর বিভাগের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার বোন, যাকে পদোন্নতি দিতে সব নিয়ম ভেঙে এই বির্তকিত তালিকা তৈরি করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ওই প্রভাবশালী কর্মকর্তা কিছু কর পরিদর্শককে নিয়ে একটি অনুসারী চক্র তৈরি করেছেন, যাদের পদোন্নতি দিতেই এই বিতর্কিত তালিকা তৈরি করেছেন। এতে সহযোগিতা করছেন অপর এক কর্মকর্তা। এই খসড়া তৈরিতে বিভাগীয় কর পরিদর্শকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও মানা হয়নি। এমনকি নন-ক্যাডার কর পরিদর্শকের ক্ষেত্রে পিএসসির মেধাতালিকা অনুসরণ করা হয়নি। স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বার্থ হাসিলের এই চূড়ান্ত খসড়া তালিকা মানেন না কর পরিদর্শকরা। এই অনিয়মের বিষয়ে তারা আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছেন।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, কর পরিদর্শকের মোট পদের সংখ্যা ৯৮৬টি। ২০১৬ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, ৫০ শতাংশ পদোন্নতি ও ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। বিধিমালা অনুযায়ী প্রধান সহকারী ও ইউডি থেকে ৬২ শতাংশ, গ্রাফার থেকে ৯ শতাংশ এবং স্টেনো টাইপিস্ট থেকে ২৯ শতাংশ হিসেব করে পদোন্নতি দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ২২ মার্চ এই নিয়মে ৪৫০ জনকে কর পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পদোন্নতির সেই কোটা হিসেব করে ৪৫০ থেকে ১৩০ জনকে ২০১৯ সালে অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (ইএসিটি) পদে পদায়ন করা হয়। এরপর দীর্ঘ চার বছরেও ইএসিটি পদে পদায়ন করা হয়নি। বর্তমানে ৮৭টি ইএসিটি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া নতুন কর অঞ্চলের কাজ শুরু হলে পদ আরও বেড়ে যাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০