বিদ্যুতের দাম নিয়ে গণশুনানি শুরু কাল: গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানোর প্রস্তাব ৬ থেকে ১৪.৫%

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়তে যাচ্ছে। এজন্য গত বছর সেপ্টেম্বর ও চলতি বছর মার্চে দুই দফা প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। এরই মধ্যে প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই শেষ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ছয় থেকে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের ওপর আগামীকাল থেকে গণশুনানি শুরু হবে। বিইআরসি আইন-২০০৩ অনুযায়ী, গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে দাম নিয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। এর আগে ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে পাইকারি পর্যায়ে পাঁচবার এবং খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি ইউনিট (১ কিলোওয়াট) ছিল ছয় টাকা ২৭ পয়সা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৮০ পয়সা। আর গত অর্থবছরে তা এ খরচ আরও কমে হয়েছে পাঁচ টাকা ৫৯ পয়সা। এরপরও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জানানো হয়েছে। তবে পিডিবির সূত্র বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে তেলও (ফার্নেস অয়েল) কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি পড়ছে। তাই দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি, প্রতিবারই পাইকারির তুলনায় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে কম। ফলে তাদের পক্ষে কোম্পানি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে বিইআরসিতে উপস্থাপন করা বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে একমাত্র পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) লোকসান দিচ্ছে। অন্য চারটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। এ কোম্পানিগুলো হলো পিডিবির বিতরণ অঞ্চল, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো)।

এদিকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (নওজোপাডিকো) নতুন গঠিত হয়েছে। পিডিবির রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সম্পদ ও দায়দেনা নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করা এ কোম্পানি এবারই প্রথম বিইআরসির কাছে বিদ্যুতের দাম  নির্ধারণের প্রস্তাব নিয়ে আসছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিক্রিতে পিডিবির দর অনুসরণ করছে কোম্পানিটি।

পাইকারি দাম বাড়ানোর জন্য পিডিবির দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহ করতে গড়ে ব্যয় হয় পাঁচ টাকা ৫৯ পয়সা। কিন্তু বর্তমানে প্রতি ইউনিটের দাম নির্ধারিত আছে চার টাকা ৮৭ পয়সা। এখন দাম বাড়িয়ে এই ৭২ পয়সার ব্যবধান ঘোচানো দরকার। না হলে পিডিবির পক্ষে এই অর্থের সংস্থান সম্ভব নয়। এজন্য প্রায় ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।

গ্রাহকপর্যায়ে ডিপিডিসি ছয় দশমিক ২৪ শতাংশ, ডেসকো ছয় দশমিক ৩৪ শতাংশ, ওজোপাডিকো ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশ, আরইবি ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও পিডিবি ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া দু-একটি বিতরণ কোম্পানি গ্রাহকপর্যায়ে ডিমান্ড চার্জ ও সার্ভিস চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বলে বিইআরসির সূত্র জানায়। বর্তমানে কোম্পানিভেদে প্রতিটি মিটারে প্রতি মাসে ৩০ টাকা পর্যন্ত ডিমান্ড চার্জ ও ২০ টাকা পর্যন্ত সার্ভিস চার্জ ধার্য আছে। এটিকে ৫০ ও ৩০ টাকা করার প্রস্তাব এসেছে।

এদিকে বড় শহরগুলোয় গ্রাহকদের আলাদা ট্যারিফ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পিডিবি। এক্ষেত্রে শহরের বহুতল বাড়ি ও যৌথভাবে গড়ে তোলা সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত আবাসিক ভবনগুলোয় সর্বোচ্চ হারে ট্যারিফ রেট আরোপ করা হবে। তবে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিলের ওপর মাসে দুই শতাংশ রিবেটের প্রস্তাবও করা হয়েছে। এছাড়া নির্মাণাধীন আবাসিক ভবন, ব্যাটারিচালিত রিকশা বা থ্রি-হুইলারের ব্যাটারি চার্জে পৃথক হারে বিল পরিশোধ করতে হবে।

লাভজনক বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিইআরসির সদস্য (বিদ্যুৎ) মো. মিজানুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, কোম্পানিগুলোর লাভ-লোকসানের সব তথ্যই গণশুনানিতে প্রকাশিত হবে। তার ভিত্তিতেই বিইআরসি সিদ্ধান্ত নেবে। প্রস্তাব করলেই যে দাম বাড়ানো হবে, বিষয়টি এমন নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দাম বাড়ানোর বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। আর তা হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের (ফার্নেস) দাম বাজারমূল্যে সরবরাহ করা। বর্তমান বাজারদরে ফার্নেস তেল থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ছয়-সাত টাকার মতো। যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সরকার ফার্নেস তেল আমদানি করার লাইসেন্স দিয়েছে, তারা বর্তমানে এই দামে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। অন্যদিকে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামে ফার্নেস তেল নিচ্ছে, তাদের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১২-১৩ টাকা। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি লিটার ফার্নেস তেলের দাম ২২ থেকে ২৪ টাকা আর বিপিসি বিক্রি করে ৪২ টাকা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, এবার দাম বাড়ানোর বর্তমান প্রক্রিয়া অযৌক্তিক। কারণ বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ অনুসরণ করছে না, বরং বেশি দামের তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেলের দাম বাজারদর অনুযায়ী করে দিলেও উৎপাদন ব্যয় অনেকখানি কমত। তাও করা হচ্ছে না। পদ্ধতিগত লোকসান (সিস্টেম লস) কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর কার্যক্রমও যথেষ্ট সফল নয়। এগুলো করা হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না, বরং কমানো সম্ভব হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০