শিক্ষাব্যয় মেটাতে দিশাহারা যশোরের অভিভাবকরা কমেনি কোচিং ও প্রাইভেট নির্ভরতা

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষা কারিকুলামে আনা হয়েছে পরিবর্তন। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পাঠদান, শিক্ষকদের পড়ানোর কৌশল কোনো কিছুতেই আস্থা আনতে পারছে না অভিভাবকরা। এতে করে অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রাইভেট ও কোচিং শিক্ষার ওপর নির্ভর হয়ে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। তার সঙ্গে বাড়তি যোগ হচ্ছে স্কুলের অতিরিক্ত ক্লাস মূল্যায়ন পরীক্ষার আনুষঙ্গিক শিক্ষা উপকরণের বাড়তি জোগান।

তবে শিক্ষা বিভাগ বলছে, বিষয়টি নতুন হওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছে কঠিন মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে জনপ্রিয়তা পাবে।

অভিভাবকরা জানান, নতুন কারিকুলাম চালু হওয়ার পর শিক্ষা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল নতুন এই পদ্ধতিতে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের প্রয়োজন হবে না। এমনকি কোচিংয়েরও কোনো প্রয়োজন হবে না। কিন্তু এখন এর উল্টোটা হচ্ছে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না অভিভাবকরা। যে কারণে অভিভাবকরা অনেকটা শঙ্কিত হয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোচিংয়ে ভর্তির পাশাপাশি বাসায় একাধিক প্রাইভেট শিক্ষক দিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন। এর বাইরে ক্লাসে প্রতিদিন মূল্যায়ন পরীক্ষার নামে যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে সেখানে আর্ট পেপার, মার্কার, সিগনেসার পেন, রংসহ আনুষঙ্গিক উপকরণের জোগান দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে যশোর জিলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, নতুন কারিকুলামে ইংরেজি ও অঙ্ক বিষয়ে অনেক ঘাটতি রয়েছে। আগে যে কারিকুলামে বাচ্চারা পড়াশোনা করত সেখানে যেমন অঙ্ক বিষয়ে একটি অনুশীলনীতে তিন চারটি উদাহরণ থাকত। চর্চা করার জন্য একাধিক অনুশীলন থাকত। কিন্তু বর্তমান কারিকুলামে বাচ্চাদের শেখার জন্য এমন কোনো অনুশীলন নেই। একই অবস্থা ইংরেজির ক্ষেত্রে। আগে ইংরেজি বিষয়ে গল্প, কবিতা, নিবন্ধ থাকত। এসব কবিতা, গল্প, নিবন্ধ বাসায় পড়ে বাচ্চারা স্কুলে যেত। তারা নীতি-নৈতিকতাও শিখতো বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে। এখন নতুন কারিকুলামে এর ছিটেফোটা নেই। যে কারণে বাচ্চাদের অঙ্ক, ইংরেজি ও বাংলার ওপর বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে বাসায় বাড়তি বেতনে আলাদা টিচার দিয়ে শেখানো লাগছে।

প্রায় একই কথা বলেন, যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা কবিতা আফরোজ। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এখন নেই বললে চলে। যে কারণে আমরা অনেকটা প্রাইভেট শিক্ষার ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছি। নতুন কারিকুলামে যেভাবে বাংলা-ইংরেজি, অঙ্ক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সে ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী এই তিনটি বিষয় রপ্ত করতে পারছে না। যে কারণে আমাদের বাড়তি খরচ করে বাসায় প্রাইভেট টিচার রাখা হচ্ছে। আবার কোচিংয়েও বাচ্চাদের ভর্তি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পদ্ধতি নেয়। অথচ মূল্যায়নের নামে কথিত যে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে সেখানে একজন বাচ্চার জন্য প্রায় প্রতি সপ্তাহে আর্ট পেপার, মার্কার, কালার পেজ, রং পেন্সিল, গøু গান আঠাসহ আরও অনেক উপকরণ কিনে দিতে হচ্ছে। এতে করে একজন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর পেছনে মাসে প্রাইভেট টিচারসহ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে।

ফাতিমা খাতুন নামে যশোর জিলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীর মা ফাতেমা খাতুন বলেন, আমার দুই ছেলে ওই স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের ক্লাসে মূল্যায়ন পরীক্ষার জন্য আর্ট পেপার, মার্কার, কালার পেজ, রং পেন্সিল, গøু গান আটাসহ আরও অনেক উপকরণ কিনে দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপর বাড়তি চাপ রয়েছে শিক্ষকদের অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ। তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামে দলগত যে শিক্ষা দেয়া হয় সেটি মূলত দলনেতার ওপর শতভাগ চাপ থাকে। গ্রæপে অন্য যে শিক্ষার্থীরা থাকে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। দলনেতা ৮-১০ জন শিক্ষার্থীর পক্ষে অ্যাসাইনমেন্ট লিখে ক্লাস শিক্ষকের কাছে জমা দেয়। এসব কারণেই অভিভাবকদের বাসা বা কোচিংয়ে বাচ্চাদের ভর্তি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নারায়ন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, নতুন কারিকুলাম নতুন বলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে অন্য রকম মনে হচ্ছে। আসলে এখান থেকে অনেক শেখার আছে। এটি সবাই যখন পুরোটা আয়ত্তে আনতে পারবে তখন এ নিয়ে বিতর্ক থাকবে না। তিনি বলেন, প্রাইভেট টিচার, কোচিং বাণিজ্য রোধ ও বাচ্চাদের ওপর চাপ কমাতে এ পদ্ধতি চালু। অথচ অভিভাবকরা এখন সেটি আরও বেশি বেশি করে বাড়তি খরচ করছে।

এ বিষয়ে যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. মাহফুজুল হোসেন বলেন, যেকোনো নতুন বিষয়ের ওপর পূর্ণ ধারণা পেতে একটু সময় লাগতেই পারে। অভিভাকরা হয়তো মনে করছেন তাদের সন্তানরা পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু তা না, শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এগুলো বাচ্চাদের বোঝাতে সক্ষম হলে তখন আর কোনো সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, শিক্ষার্থী মূল্যায়নে আনুষঙ্গিক শিক্ষা উপকরণ কিনতে অভিভাবকদের ওপর যে বাড়তি চাপ হচ্ছে সেটি ভবিষ্যতে থাকবে বলে মনে হয় না। সরকার এ বিষয়টি নিয়েও ভাবছে বলে তিনি জানান।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০