রহমত রহমান: বর্তমানে দেশেই তৈরি ও সংযোজন করা হচ্ছে বিশ্বসেরা সব ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন। মূসক ছাড় দেয়ায় দেশি-বিদেশি ১৬টি মোবাইল সেট উৎপাদন ও বাজারজাতকারী কোম্পানি বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করেছে। দেশে উৎপাদিত এসব মোবাইল সেট দেশের চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ করছে। উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর বাজেটে স্থানীয় মোবাইল সেট উৎপাদনের ক্ষেত্রে মূসক হার কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর এই বৃদ্ধির অজুহাতে মূসক আদায় যেন উল্টোপথে হাঁটছে। অর্থাৎ নামি বেশিরভাগ ব্র্যান্ডের মোবাইল উৎপাদনকারী কোম্পানি থেকে মূসক আদায় কমতে শুরু করেছে। যেমনÑনকিয়া, শাওমি, জেডটিই, ফাইভ স্টার, বেনকো, টেকনো, বেঙ্গল ও লিনেক্স ব্র্যান্ডের কোম্পানি থেকে মূসক আদায় কমেছে। আবার অপো, স্যামসাং, প্রোটন, উইনস্টার, ইনফিনিক্স, আইটেল, ভিভো ও সিম্ফনি ব্র্যান্ডের কোম্পানি থেকে মূসক আদায় কিছুটা বেড়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেটে মূসক হার বৃদ্ধি করা হলেও কাক্সিক্ষত হারে মূসক আদায় বৃদ্ধি পায়নি। মূসক আদায় বৃদ্ধিতে তদারকি করতে কমিশনারেটগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এনবিআর সূত্রমতে, দেশে ১৬টি মোবাইল ফোন সেট উৎপাদন ও সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পাঁচটি ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন রয়েছে। এর মধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের অধীন, একটি ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের অধীন, পাঁচটি ঢাকা পূর্ব ভ্যাট কমিশনারেটের অধীন, একটি ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেট ও একটি কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনারেটের অধীনে রয়েছে। ১৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) মূসক আদায় হয়েছে প্রায় ২৪১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছর চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) মূসক আদায় হয়েছে প্রায় ২৬১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত অর্থবছর মোবাইল সেটের স্থানীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে মূসক হার ছিল শূন্য, তিন ও পাঁচ শতাংশ। চলতি অর্থবছর তা বাড়িয়ে করা হয়েছে দুই, পাঁচ ও সাত শতাংশ।
সূত্রমতে, ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন আটটি প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর প্রথম চার মাসে মোট মূসক আদায় হয়েছে ১০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে ৮৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ চার মাসে মূসক কমেছে ২২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বাকি আটটি কোম্পানি থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে ১৩৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে ১৭৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ চার মাসে মূসক আদায় বেড়েছে ৪২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, পাঁচটি কমিশনারেটের মধ্যে কেবল ঢাকা পূর্ব ভ্যাট কমিশনারেটের অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোয় মূসক বাড়ছে। এই কমিশনারেটের অধীনে রয়েছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি নরসিংদীর শিবপুরে কারখানা স্থাপন করেছে, যাতে স্যামসাং মোবাইল ফোন সেট উৎপাদন করে। এই কারখানায় উৎপাদিত মোবাইল হ্যান্ডসেট থেকে গত অর্থবছরের প্রথস চার মাসে মূসক পাওয়া গেছে ১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মূসক পাওয়া গেছে ১৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মূসক বেড়েছে এক কোটি ৮৯ লাখ টাকা, আদায় প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আরএফএল ইলেকট্রনিকস লিমিটেড প্রোটন ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে গত অর্থবছর চার মাসে কোনো মূসক আদায় হয়নি। চলতি অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা।
হিসাবে আরও দেখা গেছে, আনিরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড উইনস্টার, টাইটানিক, ডিসকভারি, জেডটিই ফোন উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা। ইসমাতু টেকনোলজি বিডি লিমিটেড (ট্রান্সশান বিডি লিমিটেড) টেকনো, আইটেল ও ইনফিনিক্স ব্র্যান্ডের মোবাইল উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এই কোম্পানি থেকে গত অর্থবছর কোনো মূসক পায়নি। চলতি অর্থবছর চার মাসে ৫৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা মূসক পেয়েছে। বেষ্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড দেশে ভিভো ব্র্যান্ডের মোবাইল উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এই কোম্পানি থেকে গত অর্থবছর চার মাসে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মূসক আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে ১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠান থেকে মূসক আদায় প্রবৃদ্ধি ২১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোয় মূসক কমেছে সবচেয়ে বেশি। অথচ এই কমিশনারেটের অধীনে রয়েছে দেশি-বিদেশি নামি সব মোবাইল সেট উৎপাদন ও সংযোজনকারী কোম্পানি রয়েছে। আল-আমিন অ্যান্ড ব্রাদার্স গাজীপুরে ফাইভ স্টার মোবাইল ফোন উৎপাদন ও বাজারজাত করে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে ৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড নিজস্ব ব্র্যান্ড জিডিএল তৈরি ছাড়াও লাভা, বেনকো, জাইওনি, জেডটিই হ্যান্ডসেট তৈরিতে সাহায্য করে। এই প্রতিষ্ঠান গত অর্থবছর চার মাসে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকা মূসক দিয়েছে। আর চলতি অর্থবছর চার মাসে মূসক দিয়েছে দুই কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কার্লকেয়ার টেকনোলজি বিডি লিমিটেড হলো টেকনো, ইনফিনিক্স, আইটেল, ওরাইমো ও সিনিক্স ব্র্যান্ডের বিক্রয়োত্তর পরিষেবা ব্র্যান্ড। এই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থবছর চার মাসে ২০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা মূসক আদায় হলেও এই অর্থবছর কোনো মূসক আদায় হয়নি। বেনলি ইলেকট্রনিক এন্টারপ্রাইজ কোং লিমিটেড হলো অপো ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে ১৮ কোটি ৬ লাখ টাকা। আর অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে ৩৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ আদায় প্রবৃদ্ধি ১০২ দশমিক ২১ শতাংশ।
আরও দেখা গেছে, ডিবিজি টেকনোলজি বিডি লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশে স্মার্টফোন তৈরি করছে শাওমি। ডিবিজি একটি গেøাবাল ইএমএস কোম্পানি, তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবসা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য কিছু ব্র্যান্ড ও কনজ্যুমার ইলেকট্রনিকস পণ্য তাদের কারখানায় তৈরি হয়। ডিবিজি থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে ৫৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে ৪২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বাংলাট্রনিকস টেকনোলজি লিমিটেড থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে ৯৭ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের চার মাসে আদায় হয়েছে ৯২ লাখ টাকা। ইউনিয়ন টেক পার্ক লিমিটেড নকিয়া ব্র্যান্ডের সরবরাহকারী। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে পাঁচ কোটি দুই লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে ৭৭ লাখ টাকা। লিনেক্স ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশ লিমিটেড বেঙ্গল ও লিনেক্স ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন উৎপাদন করে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে প্রায় ৫১ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের চার মাসে আদায় হয়েছে প্রায় ৬৭ লাখ টাকা।
হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন মাইসেল টেকনোলজি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মাইসেল ব্র্যান্ডের এই মোবাইল প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছর চার মাসে মূসক আদায় হয়েছে মাত্র আট লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে চার লাখ টাকা। ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এডিসন গ্রæপের এই প্রতিষ্ঠান সিম্ফনি ব্র্যান্ডের মোবাইল সেট উৎপাদন ও বাজারজাত করে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছরের চার মাসে আদায় হয়েছে ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন হালিমা মোবাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড থেকে গত অর্থবছর কোনো মূসক আদায় হয়নি। চলতি অর্থবছর চার মাসে আদায় হয়েছে ২২ হাজার টাকা।
অপরদিকে একাধিক কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডলার সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন, এলসি খুলতে না পারা, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, শিপমেন্টে বাড়তি ব্যয়সহ নানা সংকটের কারণে মোবাইল সেটের উৎপাদন কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে মূসক আদায়ে। এছাড়া মূসক হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও উৎপাদনকারীরা সংকটে পড়েছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, মূসক হার বাড়ানোর ফলে মূসক আদায় বাড়ার কথা। কিন্তু গত অর্থবছরের তুলনায় এই অর্থবছরের চার মাসে কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। কমিশনারেটগুলোর তদারকি বাড়ানো হলে মূসক বাড়তে পারে।