বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নাধীন অতিদরিদ্রদের জন্য আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের কাজ ৭ জানুয়ারি সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ছিল। প্রকল্পের কাজ শেষ না করে নামমাত্র কাজ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারা করার অভিযোগ উঠেছে উপজেলার ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নের দুই ইউপি সদস্যসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতাভুক্ত স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের ন্যূনতম সুফল বঞ্চিত হয়েছেন প্রকল্পভুক্ত জবকার্ডধারী উপকারভোগীরা। ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ভেস্তে যাওয়ার ক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন প্রকল্প এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষ।
সূত্রমতে, অতিদরিদ্রদের জন্য আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) প্রকল্পে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম পর্যায়ের বাজেটে জেলার কচুয়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের দুই হাজার ৯২৮ উপকারভোগী অনুযায়ী নন-ওয়েজ কস্ট খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৫ টাকা। ওয়েজ কস্ট খাতে বরাদ্দ রয়েছে চার কোটি ৬৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নে ৩৪৮ জবকার্ডধারী উপকারভোগী রয়েছে। ৩৪৮ উপকারভোগীর বিপরীতে এই ইউনিয়নে প্রকল্প রয়েছে ৯টি। প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে প্রকল্পের নন-ওয়েজ কস্ট খাতের টাকা কোথায় কীভাবে ব্যবহƒত হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, কড়ইয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আকানিয়া উত্তর পাড়া জসিমের বাড়ি থেকে তালুকদার বাড়ি হয়ে হাশেম মাস্টারের বাড়ির পশ্চিম পাশের রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ১০০ মিটার পর্যন্ত মাটির কাজ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ৪৬ জবকার্ডধারী উপকারভোগী রয়েছে। ইজিপিপি নির্দেশনা অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ না করেই উপজেলার প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে ইউপি সদস্য মো. কামরুজ্জামান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি কামরুজ্জামান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে গ্রামীণ রাস্তা পাকাকরণ প্রকল্পে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারা করারও অভিযোগ ওঠে।
৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কামরুজ্জামান কাঞ্চন প্রকল্পের তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আকানিয়া জমির উদ্দিন হাজীবাড়ি থেকে মৌলভী সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে। সেখানে উপকারভোগী রয়েছে ৪৬ জন।
ইউনিয়নের প্রকল্প তালিকা অনুযায়ী আকানিয়া উত্তর পাড়া জসিমের বাড়ি থেকে তালুকদার বাড়ি হয়ে হাশেম মাস্টারের বাড়ির পশ্চিম পাশের রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্প নামে ইজিপিপি প্রকল্প থাকলেও কাঞ্চন মেম্বার সে বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। তবে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করতে ভুয়া একটি প্রকল্পের নাম বলেছেন এ প্রতিনিধিকে।
অনুসন্ধানকালে আরও জানা গেছে, ইউপি সদস্য কাঞ্চন মিথ্যা তথ্য দিয়েই প্রকল্পের ৪৬ উপকারভোগী জবকার্ডধারীর প্রায় সাত লাখ ১৬ হাজার টাকা আত্মসাতের পাঁয়তারা করছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে কাজ না করেই প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করতেই নামসর্বস্ব ভুয়া প্রকল্পের কথা বলছেন। এমন অভিযোগ প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দাদের।
প্রকল্প এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয়দের অভিযোগ, রাস্তার কারণে ছেলে-মেয়েদের বিয়েশাদি পর্যন্ত হচ্ছে না। প্রতিবছরই রাস্তা করার আশ্বাস দিয়ে কাঞ্চন মেম্বার আর রাস্তার কাজ করছেন না। কোনো প্রকল্প এলাকায় ১১ বছরের মধ্যে কোনো সাইনবোর্ড পর্যন্ত লাগায়নি ইউপি সদস্য কাঞ্চন।
অপরদিকে একই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে চাঁদপুর বারেক মাস্টারের বাড়ির ব্রিজ থেকে চাঁদপুর বড় বাড়ির মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ১০০ মিটার মাটির কাজ করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আবুল হাশেম। এই প্রকল্পে উপকারভোগী রয়েছেন ৩৯ জন। ৭ জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ১০০ মিটার মাটির কাজ করে অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারা করছেন আবুল হাশেম মেম্বার, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
যদিও ইউপি সদস্য আবুল হাশেম শেয়ার বিজকে জানান, বাকি কাজ তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ করবেন। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিপাটি একটি রাস্তায় প্রকল্প দেয়া হয়েছে। এই রাস্তাটি মানুষের চলাচলের উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও এখানে প্রায় ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকার প্রকল্প দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। ইউএনও সাহেব রাস্তা দেখেছেন। রাস্তার কাজ প্রায় ১০০ মিটার হয়েছে। বাকি কাজ হয়নি কেনÑএমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি কি অভিযোগ করবেন রাস্তার বিষয়ে? এরপর অসংখ্যবার কল করেও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সূত্রমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ইজিপিপি প্রকল্পের প্রভার্টি ইনডেক্স অনুযায়ী, এ ক্যাটেগরিতে থাকা কচুয়ার ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নে দারিদ্র্যের হার ৪০ দশমিক ২০ ভাগ উল্লেখ থাকলেও রহস্যজনক কারণে তালিকা থেকে বাদ পড়েছে অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ। এতে নামমাত্র কাগজে-কলমে উপকারভোগী থাকলেও প্রকৃত অসহায় দিনমজুর মানুষজন প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পে বরাদ্দকৃত টাকা পরিশোধে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে দাখিলকৃত উপকারভোগীদের মোবাইল নম্বর-সংবলিত তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের নিয়ম থাকলেও স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের কারণে কেউই তালিকা যাচাই-বাছাই করছেন না। বিগত সময়ে সিমকার্ডধারী উপকারভোগীদের মোবাইলে টাকা আসার পর সেই টাকা কৌশলে উত্তোলন করে সামান্য কিছু টাকা তাদের দিয়ে প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে দুই ইউপি সদস্যদের বিরুদ্ধে। উপকারভোগীদের সিমকার্ড নিজেদের কাছে রেখে ৫০০ টাকায় বাইরের শ্রমিক দিয়ে প্রকল্পের নামমাত্র কাজ করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এমন অভিযোগ ৬নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের। তবে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার, ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতির যোগসাজশ থাকতে পারে বলে শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।
প্রকল্পে কাজ না হওয়ার ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান আবদুছ সালাম সওদাগর শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পের কাজ সব সমন্বয় করে ইউপি সদস্য কামরুজ্জামান কাঞ্চন। আপনারা চাঁদপুর থেকে এসে এত কিছু কেন দেখেন? কচুয়াতেও তো সংবাদিক আছে, তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলব।”