ট্রেজারি বিল-বন্ডের ৭৭% কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক

রোহান রাজিব: ট্রেজারি বিল-বন্ডে বেশিরভাগ বিনিয়োগ করে থাকে প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ও নন-প্রাইমারি ডিলার (নন-পিডি)। তবে বিদায়ী অর্থবছরে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। গত অর্থবছরে সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে, তার ৭৭ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকি অংশ কিনেছে পিডি ও নন-পিডি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকায়। তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার ২৯৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিল-বন্ডে বিনিয়োগ বেড়েছে এক লাখ ৪৬৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বা ২৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের ১ লাখ ৪৬৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বিনিয়োগের ৭৭ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের, যা মোট বিনিয়োগের ৭৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। মূলত গেল অর্থবছরে সরকারের ঋণ চাহিদা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মেটাতে পারেনি।

কারণ ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনায় টাকা বাজার থেকে উঠে গেছে। তাই বিল-বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে নিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। গেল অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে, তার পুরোটাই টাকা ছাপিয়ে দেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চলতি অর্থবছরে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির নিট ডিভলভমেন্টের স্থিতি কমে আসছে। শুধু তা-ই নয়, বাজারের তারল্যপ্রবাহ কমাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের দেনা পরিশোধ করা হচ্ছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংকঋণও ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুনের তুলনায় ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমেছে ৩৪ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার নিয়েছে ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। দুইয়ে মিলে ব্যাংক খাতে সরকারের নিট ঋণ কমেছে ৩ হাজার ১১ কোটি টাকা। এ প্রবণতার কারণে ট্রেজারি বিলের সুদহার হুহু করে বেড়ে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশে উঠেছে। এযাবৎকালের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ট্রেজারি বন্ড ও গ্রাহক পর্যায়েও সুদহার দ্রুত বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া বন্ধ করেছি। পাশাপাশি ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এখন সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডেরও সুদহার বেশি। এটা জনগণের জন্য সুযোগ। কারণ ট্রেজারি বিল বন্ড এখন ব্যাংকের চেয়ে সুদহার বেশি। এখানে বিনিয়োগের কোনো লিমিট নেই। ব্যাংকের চেয়ে উৎসে করও কম। এখানে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের চেয়ে জনগণ লাভবান হতে পারবে। এছাড়া এ বিনিয়োগে কোনো ঝুঁকি নেই।

গেল অর্থবছরে বিল-বন্ডের সিংহভাগ বাংলাদেশ ব্যাংক কিনেছে। এ কারণে সরকারের বিল-বন্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থিতি বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ট্রেজারি বিল-বন্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ৫৩ হাজার ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছিল। গেল অর্থবছর শেষে বিনিয়োগ বেড়ে স্থিতি দাঁড়িয়েছে লাখ ৩০ হাজার ৮৮৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকায়, যা মোট বিনিয়োগের ২৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

এদিকে পিডি ও নন-পিডি ব্যাংকের বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। কারণ তারল্য সংকট থাকার কারণে ট্রেজারি বিল-বন্ড ম্যাচিউরিটি হওয়ার পর নতুন করে বিনিয়োগ করেনি, যার কারণে পরিমাণগত বিনিয়োগ কিছুটা বাড়লেও শতাংশ হারে কমেছে। বর্তমানে ২৪টি পিডি ও ২৪টি নন-পিডি ব্যাংক রয়েছে দেশে। তবে এখনও বিল ও বন্ডে পিডি ব্যাংকের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে।

তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে পিডি ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ৪৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গেল অর্থবছরে স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩১ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়, যা মোট বিনিয়োগের ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ।

পিডি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিল ও বন্ড কিনেছে ব্র্যাক ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে এরপরে রয়েছে মধুমতি, সাউথবাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এনসিসি, ইস্টার্ন, মিডল্যান্ড, রূপালী, সিটি ও মিচুউয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।

অন্যদিকে গেল অর্থবছরে নন-পিডি ব্যাংকের বিনিয়োগ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ২২৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়, যা মোট বিনিয়োগের ২৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থিতি ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৫২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা ৩০ দশমিক ১৭ শতাংশ।

এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪৮ কোটি টাকায়, যা মোট বিনিয়োগের শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ। আমানত বিমা ট্রাস্টের বিনিয়োগ রয়েছে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, সাধারণ লাইফ ইন্সুরেন্সের শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ, লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ, করপোরেট সংস্থার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ, বিনিয়োগ কোম্পানির শূন্য দশমিক ০৫ শতাংশ, প্রভিডেন্ট/পেনশন/ট্রাস্ট ও গ্রাচুইটি তহবিলের ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, মিচুউয়াল ফান্ডের শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ রয়েছে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের পরিমাণ ও শতাংশের হার দুই দিক দিয়েই কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থিতি কমে ১ হাজার ১০২ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তার আগের অর্থবছরে যা ছিল ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা বা শূন্য ৩৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গেল অর্থবছর শেষে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৬১৮ কোটি ৯২ লাখ টাকায়, ১৮২ দিন মেয়াদি বিলের স্থিতি ৩৯ হাজার ৮৬৭ কোটি, ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের স্থিতি ৪৮ হাজার ১৯৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়।

অন্যদিকে দুই বছর মেয়াদি বন্ডের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়, পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডের ঋণের স্থিতি ৯৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা, ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ঋণের স্থিতি ১ লাখ ১১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, ১৫ বছর মেয়াদি ৫৫ হাজার ২১০ কোটি এবং ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, গেল অর্থবছরে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিয়োগ বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ পাচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিল-বন্ড কিনে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঋণ দেয়া মানে টাকা ছাপিয়ে দেয়া। টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেছে। তবে চলতি অর্থবছরে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ করছে। এজন্য ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ছে না, মূলত এ সম্পর্কে মানুষ জানে না। মানুষকে জানাতে হবে। তাহলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়বে, আর এতে সময় লাগবে। প্রচার-প্রচারণাও বাড়াতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০