অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-১৪…
মিজানুর রহমান শেলী: ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাস এ বাংলায় অতি প্রাচীন। শিল্পোদ্যোগও এখানে বিকশিত হয়েছে দূরাতীতকাল থেকে। সময় ও সক্ষমতাভেদে এ উদ্যোগ সব সময়ই হরেক রকমের। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলটিই কেবল উদ্যোক্তা বিকাশের বন্ধ্যত্বকাল। এ শুষ্কতা কাটিয়ে উঠতে বাঙালিকে প্রাণান্তকর সংগ্রাম আর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে।
উদ্যোক্তা চিন্তার বিকাশ প্রথম শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ ভাগে। ১৮৭১ সালে কার্ল মেঞ্জার তার ‘প্রিন্সিপল অব ইকোনমিকস’ বইতে লেখেন, পরিস্থিতির চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয় না। বরং পরিস্থিতিকে সচেতনভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। উনিশ শতকের এ চিন্তা বিশ শতকের ব্যবসা-বাণিজ্যে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এ সময়ে অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ জোসেম জুমপিটার বলেন, উদ্যোগ হলো একধরনের ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন। এটা কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে আরও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নির্মাণ করে। তার মতে, একজন উদ্যোক্তা হলেন একজন উদ্ভাবক। তিনি সম্পদের নতুন সমন্বয় আনেন এবং সম্পদ বিনিময়ের নতুন সব পথ বাতলে দেন। এমনকি সমাজের স্ট্যাটাস কুয়ো বা প্রশ্নবিদ্ধ সনাতনি অবস্থা ভেঙে ফেলেন। জুমপিটার তার বইয়ে ফ্রেঞ্চ অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ক্যান্টিলনের ১৭৫৫ সালে দেওয়া ধারণাকে সমর্থন করে বলেন, উদ্যোক্তা হলেন একজন ঝুঁকিগ্রহীতা।
ভারতে বিশ শতকের উদ্যোক্তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে সে রকম পরিস্থিতিই চোখে পড়ে। এ সময় ভারতীয়দের ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ করা ছিল অনেকটাই অবাস্তব। তবে যারা উদ্যোগ নিয়েছেন, তারা সমাজের স্ট্যাটাস কুয়ো ভেঙে সফল হয়েছেন। কাজটি ছিল তাদের জন্য অতিশয় ঝুঁকিপূর্ণ।
কার্যত বাংলা অঞ্চলটি দূরাতীত কাল থেকে কৃষির জন্য ছিল উর্বর ক্ষেত্র। তখন ব্যবসা-বাণিজ্যও চলেছে আরব, দূরপ্রাচ্য ও ইউরোপীয়দের সঙ্গে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানই ছিল আগের দিনে সমৃদ্ধির মাপকাঠি। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগযোগব্যবস্থার প্রভ‚ত উন্নয়ন সাধিত হয়। পাশাপাশি আরব থেকে বহু বণিক এখানে আসেন। তারা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসায় কাঠামো গড়ে তোলেন। এ বিস্তীর্ণ ব্যবসা নেটওয়ার্কের বদৌলতে বাঙালির ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। আর এ ধরনের শিল্প বিকাশকে রিচার্ড ক্যান্টিলনের ভাষায় শিল্পোদ্যোগ বলতে হয়।
প্রাক্-মোগল মুসলিম বাংলায় ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় শিল্পোদ্যোগের এমন এক শ্রেণিকাঠামো গড়ে ওঠে। হস্তশিল্প, তাঁতের কাজ, দুগ্ধজাত পণ্যদ্রব্য, সোনা রুপার অলংকার, হাড়ের চিরুনি ও বোতাম, শাঁখা ও লাক্ষাশিল্প, ট্যানারি, কাগজসহ ইত্যাকার পণ্য প্রস্তুতে তাদের ছিল নিপুণ কারিগরি দক্ষতা। এসব ব্যবসায় উদ্যোগে গতি এসেছিল মূলত রাজমহল থেকে রাজধানী যখন ঢাকায় স্থানান্তর হয়। ধীরে ধীরে ঢাকা হয়ে ওঠে দক্ষিণ-এশিয়ার শিল্পোদ্যোগ ও বাণিজ্যের একটি কেন্দ্রস্থল। দিল্লির মোগল বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার মসলিন বিকাশে নতুন উদ্যম পায়। মসলিন ছাড়াও এখানে সোনা, রুপা বা রেশমি সুতোয় বোনা জমিন ও পাড়ের সাধারণ ও ফুলেল নকশায় গড়া জামদানি শাড়ির কদর বেড়ে যায়। এগুলো হেজাজ, মরক্কো, তিউনেসিয়া, দিল্লির বাজার দখল করে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ফরাসিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিকের আনাগোনাও বাড়তে থাকে।
বাংলায় এ শিল্পোদ্যোগের ধারাবাহিকতা হঠাৎ করেই স্থিমিত হয়ে পড়ল। এটা ব্রিটিশ আমলের কথা। এ দেশীয় উৎপাদনকে তারা নিপীড়নমূলক উপায়ে ধ্বংস করে। কেবল ঢাকাতেই ১৭৭৬ সালে ছিল এক লাখ ৪৬ হাজার ৭৫১ জন তাঁতি। শেষ অবধি রাজশাহীর মালদহ, হরিপল ও শ্রীপুর, ময়মনসিংহের বালিকুশি ও কাগমারি, মিদনাপুরের বর্ধমান, ক্ষীরপয় ও রাধানগর এবং নদীয়ার শান্তিপুর ও বারণ অঞ্চলে ছিল উন্নত বস্ত্রশিল্প। এগুলোও ধ্বংস করে। যেসব শিল্প ও বাণিজ্য কোম্পানি আমলের প্রথম ভাগে কিছুদিন চলছিল, তা ছিল ব্রিটিশের একচেটিয়া ব্যবসা আর অর্থ কামানোর কৌশলমাত্র। ব্রিটিশ অর্থনৈতিক-ইতিহাসবিদ মেডিসনের মতে, বাঙালিকে তখন ব্রিটিশের শিল্প-বাণিজ্যের সেবাদাসে পরিণত করা হয়েছিল। এখানে শিল্প-উদ্যোগ যা গড়ে উঠেছিল, তার সব লগ্নি ছিল ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের। সেখানে ভারতীয়রা ছিল কেবল শ্রমিক। আর কৃষকরা ছিল তাদের কাঁচামালের জোগানদাতা। তাছাড়া বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্রিটিশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার মানসিকতা পোষণ করত না। তাই ব্রিটিশরাও এ বাঙালি মুসলিমদের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা বঞ্চিত করে রাখে। ফলে বাংলায় শিল্পোদ্যোগ পুরোপুরি স্তিমিত হয়ে যায়। এ শূন্যস্থান পূরণ করে ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের উদ্যোক্তারা। অবশ্য তার পুরোটাই ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। আর বাংলায় শিল্পোদ্যোগের ছিটেফোঁটা গজিয়েছিলে মাত্র। এ সময় বাংলায় জমি কেনাবেচা ও অবাণিজ্যিক খাতে অর্থ লগ্নি হতে দেখা দেয়। অবশ্য লগ্নি করার মতো যথেষ্ট অর্থ বাঙালিদের কাছে ছিল না। চাকরি বা অন্য পেশা থেকে খানিক অর্থকড়ি যা উদ্বৃত্ত হতো, তার সবই ভ‚সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করত। কেননা তখন জমিতে বিনিয়োগই ছিল কেবল নিরাপদ ও লাভজনক উপায়। তখন রেললাইন, শিপিং ও মুদ্রা অর্থনীতির ব্যাপ্তির কারণে জমি ব্যবস্থাপনা লাভজনক হয়ে ওঠে। কিছু লোক মাড়োয়ারিদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করত। তবে মাড়োয়ারিদের সহযোগিতা বাঙালিরা কমই পেয়েছে। অবশ্য বাঙালিদের এ ব্যবসা-বাণিজ্য কেবল মধ্যস্বত্বভোগী পণ্য কেনাবেচার মধ্যেই গণ্ডিবদ্ধ ছিল।
উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বাঙালিরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংকল্প করে। রামদুলাল দে, দ্বারকানাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্র মোহন বোস, কিশোরী মোহন বাগচি ও পিসি রাইয়ের নাম উল্লেখ করতে হয়। এরা সবাই আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা ব্যবহার করেই ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৮৩৪ সালের ৯ আগস্টে দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জির সম্পাদনায় জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বিদেশিরা এখানে আসলো এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে অঢেল অর্থ কামিয়ে আপন ঘরে ফিরে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে লাগলো। কিন্তু আমাদের দেশ শুষ্কতার নিমজ্জন প্রণালীতে আটকা পড়ল। সম্ভবত এই অবস্থার উত্তরণ ঘটবে না। তবুও পিছিয়ে পড়া হিন্দুস্তান সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের দেখানো পথ অনেকেই আজ অনুসরণ করছে। একই রকম উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে। এটাই লাভজনক ও দৃঢ়তার পথ। পুরস্কার পাবার মত কাজ। আর এভাবেই হিন্দুদের গা থেকে অলস ও নিশ্চেষ্ট দুর্নাম মুছে যাবে।’ ১৮৯৭ সালে এ দৃঢ়তার সুরই শোনা গিয়েছিল উদ্যোক্তাদের আরেক নকিব পি. সি. রাইয়ের বয়ানে। তিনি তার এক সহকর্মীকে বলেছিলেন, ‘যখন আমি বিসিপিডবিøউ (বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড, ১৮৯২) প্রতিষ্ঠা করলাম, তখন আমার মনে কেবল এই সংকল্পই ছিল না যে, বাঙালিরা ব্যবসায় অকর্মণ্য এই ধারণা মুছে দিব। বরং আমি এটাকে একটি মডেল ইনস্টিটিউট বানাতে চেয়েছি।’ বস্তুত উনিশ শতকের এ সময়জুড়ে বাঙালিদের আপন ভাগ্য উন্নয়নে খোলস ছাড়ার উপদেশ বাণী ছড়ানো হচ্ছিল চতুর্দিক থেকে। একটি জাগরণের জন্য যেমন উদাত্ত আহবান থেকে থেকে হেঁকে ওঠে।
যা হোক, ১৮৩৮ সালের ২১ এপ্রিল সমাচার দর্পণ পত্রিকায় লিপিবদ্ধ হয়, ‘ইউরোপিয়ানরা তাদের পুঁজির যথাযথ ব্যবহার করছে। তারা বিশ্ব সভ্যতার বুকে নিজেদের ব্যবসায় দক্ষতার বলে একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিচ্ছে। তাই আমরা দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহŸান জানাচ্ছি, আপনারা অলসতা ঝেড়ে ফেলুন। পরামর্শ দিচ্ছি ইউরোপিয়ানদের ব্যবসায় নীতি অনুসরণ করুন। পশ্চিম ভারতের লোকেরা কিভাবে ব্যবসায় উদ্যোগ সফলভাবে গ্রহণ করছে, তা দেখে আপনাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। বাঙালিরা কেবল ইউরোপিয়ানদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতেই শিখেছে। পরিতাপের ব্যাপার, ইউরোপিয়ান দরিদ্র লোকেরা ধনী হয়ে যাচ্ছে ঋণের টাকা বিভিন্ন ব্যবসায় উদ্যোগে খাটিয়ে। আর ধনী বাঙালি দিনে দিনে দরিদ্র হচ্ছে। আমাদের সম্পন্ন লোকেদের উচিত ইউরোপিয়ানের চাটুকারিতা না করে, নিজস্ব ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ করা। তখনই কেবল বাঙালিরা সমৃদ্ধির এই পথে যাত্রা আরম্ভ করতে পারবে।’
গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com
Add Comment