নিজস্ব প্রতিবেদক: একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সামাজিক বিমার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ যখন কোনো দেশের মানুষ সংকটের মুখে পড়ে তখন সেই ব্যক্তিকে আর্থিকভাবে রক্ষা করতে পারে বিমা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় দুই থেকে তিন কোটি মানুষের সামাজিক বিমা থাকা দরকার। কিন্তু দেশে এই সংখ্যা অনেক কম। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আস্থার সংকট। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাজে সমন্বয়হীনতা।
রাজধানীর ব্যাক ইন সেন্টারে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে সামাজিক বিমা ফোরামের সূচনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জার্মান উন্নয়ন সংস্থার (জিআইজেড) প্রকল্প ব্যবস্থাপক ড. সিলভিয়া পপ, ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের ঊর্ধ্বতন পরিচালক অরিঞ্জয় ধর, ইউএনডিপি বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আমিনুল আরেফিন, আইএলওর ঢাকা কান্ট্রি অফিসের চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার সৈয়দ সাদ হোসাইন গিলানি, সিপিডি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য পারভীন মাহমুদ প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিমা বাস্তবায়নের জন্য যেসব সংস্থা রয়েছে তারা যথেষ্ট সচেতন না। তাই তারা এটির বাস্তবায়নে যথেষ্ট অগ্রগতি দেখাতে পারছে না। বাংলাদেশ যেহেতু স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের বা উন্নত দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই বাংলাদেশের মানুষের জন্য সরকারের যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে সেখানেও উত্তরণের দরকার। তিনি আরও বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের অংশ হিসেবে আমাদের উচিত হবে সামাজিক বিমা কর্মসূচিতেও দেশের জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করা। এ ধরনের কর্মসূচির জন্য বাংলাদেশে এরই মধ্যে নীতিকাঠামো তৈরি হয়েছে। সেই নীতিকাঠামো বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা কীভাবে কাজ করছে সেটা দেখা দরকার।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নৈতিকভাবে সরকারের অঙ্গীকার পরিষ্কার, কিন্তু সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যেসব এজেন্সি রয়েছে তারা এখনও যথেষ্ট সচেতন না এবং তারা এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি দেখাতে পারছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য, আইনি ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক পরিস্থিতির জায়গায় দুর্বলতা এবং লোকবলের সংকট বিদ্যমান। এই যে সামগ্রিক ঘাটতি রয়েছে, সেটির আলোকে বিবেচনা করলে এ ইন্স্যুরেন্স অ্যাকশন প্ল্যানকে ২০২৫ সালের মধ্যে আইনে পরিণত করতে হবে। আর সেটা করার জন্য দুই বছর হাতে সময় আছে। এ সময় মোটেও যথেষ্ট নয়। এজন্য এ ধরনের ফোরামে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিনিধিদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেবল সামাজিক নিরাপত্তা জালের মধ্যে থাকলে চলবে না। এখন সামাজিক বিমা চালু করার সময় এসেছে। সরকারের কর্মপরিকল্পনার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আসা উচিত। কিন্তু দেশ এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। অনেক দেশ ১০০ বছর আগে সামাজিক বিমা চালু করেছে। তারা এখন এই ব্যবস্থার সুফল ঘরে তুলছে। বাংলাদেশের উচিত সেই দেশগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া।
এ বিষয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সামাজিক সুরক্ষা জালের অনেক ফাঁকফোকর আছে, যাদের সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার কথা, তারা পান না। আবার যাদের পাওয়ার কথা নয়, তারা পান। এই বাস্তবতায় সামাজিক বিমা করা চালু করা হলে এসব ফাঁকফোকর বন্ধ করা সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই সামাজিক বিমা আছে। কোথাও এই বিমা বাধ্যতামূলক, কোথাও আবার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। বাংলাদেশকে এসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। এখানে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে, তাদের একসূত্রে নিয়ে আসতে হবে।
দেশে এত দিনেও সামাজিক নিরাপত্তা বিমা না হওয়ার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করেন আইএলওর ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান টেকনিক্যাল পরামর্শক সৈয়দ সাদ হোসেন গিলানি। এর জন্য তিনি আমলাতন্ত্রের ধীরগতিকে দায়ী করেন। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করেছে আরও আট বছর আগে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের গতি খুবই কম। মূলত আমলাতন্ত্রের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ঘাটতিকে এর জন্য দায়ী করেন তিনি।
সৈয়দ সাদ হোসেন গিলানি বলেন, বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ ভার সরকারের ওপর, এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত ও ব্যক্তির ভূমিকা নেই বললেই চলে। সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে অন্যদেরও এগিয়ে আসা দরকার বলে তিনি মনে করেন। সরকার, নিয়োগকর্তা ও কর্মীÑএই তিন পক্ষকে একত্রে বসে ঠিক করতে হবে, সামাজিক বিমা রূপরেখা কেমন হবে। প্রয়োজনে আইএলও এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।
সামাজিক বিমা যেহেতু কর্মজীবী মানুষের জন্য, সেহেতু তিনি মনে করেন যে এই কাজের মূল দায়িত্বে থাকা উচিত শ্রম মন্ত্রণালয়ের। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশ বাংলাদেশের চেয়ে ছোট জিডিপি ও কম মাথাপিছু আয় নিয়ে সামাজিক বিমা চালু করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তার উদ্যোগ নেই।
সভাপতির বক্তব্যে পারভীন মাহমুদ বলেন, সামাজিক বিমা চালুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সবচেয়ে জরুরি। কোনো মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে, তা ঠিক করতে হবে। সেই সঙ্গে নলেজ ব্যাংক ও আইনি কাঠামো তৈরির পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
এ সময় জিআইজেড ইন বাংলাদেশের প্রোজেক্ট ম্যানেজার ড. সিলভি পপ বলেন, যে কেউ যেকোনো সময় অক্ষম হতে পারে। সরকারি বেসরকারি বা খাতভিত্তিক চিন্তা না করে সবার নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। আর এজন্য সামাজিক বিমা বেশ কার্যকর। তবে বিমা খাতে মানুষের আস্থা না থাকায় সরকারের শক্ত ভূমিকা ও চাকরিদাতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া সামাজিক বিমা চালু করা কঠিন বলে মনে করেন তিনি।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, বিদ্যমান বিমা করে যথাসময়ে টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। যে কারণে মানুষের আস্থা কম। আস্থা বাড়ানো ও সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে তার ও পরিবারের সদস্যদের জন্য বিমা দরকার।