চুয়াডাঙ্গায় বৃদ্ধি পাচ্ছে সরষের আবাদ

মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে চুয়াডাঙ্গায় সরষের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে কোনো প্রাকৃতিক সমস্যা না থাকায় এ জেলার কৃষকরা ক্যাশ ক্রপ হিসেবে সরষের আবাদ করেছেন। আমন কাটার পর এই সময় জমি সাধারণত পড়ে থাকে। সরষে আবাদ করে জমি ফেলে না রেখে কাজে লাগিয়েছেন কৃষকরা। সরষে কর্তনের পর এই জমিতে আবার বোরো ধানের আবাদ করবেন কৃষকরা।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে এ জেলায় ৩ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে সরষের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩১০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে, দামুড়হুদা উপজেলায় ৩১০ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ৪১০ হেক্টর জমিতে সরষের আবাদ হয়েছে। ২০২২-২৩ মৌসুমে ৩ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে সরষের আবাদ হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ মৌসুমে সরষের আবাদ হয়েছিল ২ হাজার ৮৩৬ হেক্টর জমিতে।

কৃষি অফিস সূত্রে আরও জানা গেছে, বিগত ৫ বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণের জন্য ব্লক পর্যায়ে প্রচারণা চালানো হয়। ফলে গত ৫ বছরে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে সরষের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, রোপা আউশ কাটার পর জমি ফেলে না রেখে তিনি ৫০ শতক জমিতে বারি-১৪ জাতের সরষে আবাদ করেছেন। শ্রমিক, সার, সেচ ও জমি প্রস্তুত দিয়ে প্রায় ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ওই জমিতে সরষে ভালো হয়েছে। তিনি আশা করছেন, এ বছর প্রায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় মণ সরষে পাবেন। বর্তমান প্রতি মণ সরষে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। তিনি আরও আশা করেন, আঠারো থেকে উনিশ হাজার টাকায় সরষে বিক্রি করতে পারবেন। বাড়তি সময়ে সরষে বিক্রয় করে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। সরষে কেটে আবার ওই জমিতে বোরোর আবাদ করা যায়।

চুয়াডাঙ্গা পৌরসভাধীন দিগড়ী গ্রামের কৃষক আনসার আলী ও সহোদর ইলিয়াস হোসেন জানান, আমরা দুই ভাই মিলে ৪ বিঘা জমিতে বারি-১৪ জাতের সরষের আবাদ করি। চুয়াডাঙ্গা সদর অফিস আমাদের ৫০ শতক করে ১০০ শতকের জন্য প্রদর্শনী প্লটের সঙ্গে সাইনবোর্ড ও সার, বীজ প্রদান করে। আমাদের সরষের ক্ষেত অনেক ভালো হয়েছে। গত বছর ১৪ মণ সরষে হয়েছিল। এ বছর আরও বেশি হবে। সরষে কাটার সময় হলেও তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে যে সুবিধা পাওয়ার কথা সেটা পাইনি। সুবিধা না পাওয়ায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদা উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দীন  জানান, ‘চুয়াডাঙ্গার মাটি সরষে চাষের জন্য বেশ উপযোগী। সরষে আবাদের জন্য কৃষকদের আমরা মোটিভেট করছি। উপজেলার নাটুদাহ ইউনিয়নে চলতি মৌসুমে ৫০ থেকে ৬০ হেক্টর জমিতে সরষের আবাদ হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, আমন ধান কাটার আগে সর্বশেষ সেচ দেয়ার সময় ধানের মধ্যে রিলে পদ্ধতিতে সরিষা আবাদ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে সরষে আবাদের কৃষকদের খরচ কম হয়। পরবর্তী সময়ে একটি সেচ ও অল্প সার দিয়ে কৃষকরা দেড় হাজার/দুই হাজার টাকা খরচের বিনিময়ে আট-দশ হাজার হাজার  অতিরিক্ত আয় করছেন।

সদর উপজেলার সহকারী কৃষি তহমিনা আক্তার জানান, স্থানীয় জাত বিঘায় ২-৩ মণ, টরি-৭ বিঘাতে ৩-৪ মণ, বারি-১৪, বিনা-৯ বিঘাতে ৪-৫ মণ সরষে উৎপাদন হয়ে থাকে। তিনি আরও জানান, স্থানীয় জাত, বিনা-১৪ জাতের সরষেতে শতকরা ২৫ ভাগ, টরি-৭ সরষেতে শতকরা ৩০ ভাগ ও বারি-১৪ জাতের ১ মণ সরষেতে ১৩-১৪ কেজি তেল পাওয়া যায়। সরষে জাতভেদে উঠতে ৬০ দিন থেকে ১২০ দিন সময় লাগে।

জেলার আলমডাঙ্গার মাজু ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে এই ব্লকে ২৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ৩০ হেক্টর বেশি জমিতে সরষের আবাদ করেছেন কৃষকরা। গত বছর ২২০ হেক্টর জমিতে সরষের হয়েছিল।

আলমডাঙ্গা কৃষি অফিসার রেহেনা পারভীন জানান, আলমডাঙ্গা উপজেলায় গত বছর ২ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে সরষের আবাদ হয়েছিল। চলতি বছর ২ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে সরষের আবাদ হয়েছে। তিনি জানান, কৃষি বিভাগ থেকে সরষে চাষিদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনাসহ সার্বিক সহযোগিতা করার কারণে সরষে আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার শতকরা ৭১ ভাগ সরষের আবাদ হয়েছে এই উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে বারি-১৪ জাতের। চলতি মৌসুমে কৃষকরা বারি-৯, ১৪, ১৫ জাতের সরষের আবাদ করেছেন। তিনি আরও জানান, এই মাঠে আমন ও বোরো মাঝখানে অন্য কোনো আবাদ হয় না। সরষের জাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কৃষকরা বেশি আবাদ করেছেন বারি-১৪ জাতের সরষের। এরপর বারি-৯ ও বারি-১৫ জাতের সরষের আবাদ হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ব্যাপক ভুট্টার আবাদ হয়। চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি সরষের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর আবাদ ৩ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় সরষে ভালো হয়েছে। উৎপাদনও ভালো হবে। সরষে জাতের মধ্যে বারি-১৪-১৭ বিনা ৪, ৯ এমনকি টরি (স্থানীয়) জাতের আবাদ হয়ে থাকে। বিশেষ করে রিলে পদ্ধতিতে সরষের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমন ধান কাটার ১০-১৫ দিন আগে ধানক্ষেতের মধ্যে সরষে বীজ ছিটিয়ে দেয়া হয়। এতে করে কৃষক আমনের ফলন পান ও সেখান থেকে কৃষক সরষেতেও পেয়ে থাকেন। পরে ওই জমিতে কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেন। তিনি জানান, ব্লক লেবেল থেকে পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম। সেই অনুযায়ী সরষের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।

তিনি আরও জানান, হেক্টরপ্রতি সরষের গড় উৎপাদন ১ দশমিক ৫ মেট্রিক টন হলে ৩ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে সরষে উৎপন্ন হবে ৫ হাজার ২৭২ দশমিক ৫ মেট্রি টন। উৎপন্ন সরষে থেকে তেল উৎপন্ন হবে ২ হাজার ১০৯ মেট্রিক টন। বাকি খৈল উৎপন্ন হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০