রফিক মজিদ, শেরপুর: শেরপুরের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র মধুটিলা ইকোপার্কটি নানা সমস্যা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে দিন দিন পর্যটক শূন্য হয়ে পড়ছে। অথচ এই ইকো পার্কের মনোরম আঁকাবাঁকা ও উঁচু-নিচু পাহাড়ের দৃশ্য যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমিককে মুগ্ধ করবে।
এই ইকো পার্কের প্রকৃতি ও সৌন্দর্য নয়নাভিরাম হলেও গত প্রায় দুই যুগেও পার্কের ভেতর নানা অবকাঠামো সংস্কার এবং নতুন নতুন কোনো স্থাপনা না হওয়ায় পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ইকো পার্কের ভেতরে নানা ব্যবসায়ী এবং ইজারাদাররা লোকসানের মুখে পড়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। বন বিভাগের উদাসীনতার কারণে এ জনপ্রিয় ইকোপার্কটি ধ্বংসের মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও পর্যটকরা।
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে ময়মনসিংহ বন বিভাগের আওতাধীন জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার ভারতের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা পোড়াগাঁও ইউনিয়নের প্রায় ৩২৪ একর পাহাড়ি টিলার ওপর মধুটিলা ইকোপার্কটি স্থাপন করা হয়। সে সময় একটি রেস্ট হাউস, পাহাড়ি লেকের মধ্যে প্যাডল বোর্ড, স্টার বীজ, মিনি চিড়িয়াখানা ও শিশু পার্কসহ মৎস্যকন্যা, হাতি, বাঘ, হরিণ, কুমিরসহ বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রতিকৃতি স্থাপনার পাশাপাশি পার্কজুড়ে বিভিন্ন সৌন্দর্যবর্ধক গাছ ও মৌসুমি ফুলের বাগান করা হয়।
কিন্তু বিগত দুই যুগ প্রায় ২৪ বছরে কোনো রকম সংস্কার এবং নতুন কোনো রাইডস বা স্থাপনা না করায় একই দৃশ্য বারবার পর্যটকরা দেখতে এসে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে ইকো পার্কের ভেতরে খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন খেলনা ও আসবাবপত্রের দোকানপাটের মালিকরা লোকসানের মুখে পড়েছে। সেই সঙ্গে ইকো পার্কে বিভিন্ন স্থাপনা ডেকে নেয়া ইজারাদাররাও বারবার লোকসান খেয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইজারাদাররা।
প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ইকো পার্কে শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকদের ভিড় থাকলেও এবার রাজনৈতিক ও নির্বাচনের কারণে সবে পর্যটকদের আগমন শুরু হয়েছে। কিন্তু হাতে রয়েছে মাত্র প্রায় দেড় মাস। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে পর্যটকদের আনাগোনা যতই বাড়ুক স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং ইজারাদাররা লোকসানে মুখেই পড়বে। পার্কে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও নানা অভিযোগ তুলেন ইকো পার্কের অব্যবস্থাপনা এবং নতুন কিছু না থাকায়।
এছাড়া এই পার্ক ঘিরে গড়ে ওঠা শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মোটা অঙ্গের টাকা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে কেবল পর্যটকদের ভিড় কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছে।
সেইসঙ্গে ইকো পার্কে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষা সফর ও বনভোজনে আগত পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষ কাজ না পেয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন।
এদিকে পুরো ইকো পার্কের সীমানা প্রাচীন না থাকায় প্রায়ই বন্যহাতি এসে ইকো পার্কের পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ব্যবসায়ীর দোকানপাট ভাঙচুর ও মালামালের ক্ষয়ক্ষতি করছে। এছাড়া ইকোপার্কের বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে ফেলার ঘটনায় পর্যটক এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যেও হাতির আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এছাড়া স্থানীয় এক শ্রেণির মানুষ ইকো পার্কের ভেতর টিলার ওপর বন বিভাগকে উপেক্ষা করে জুয়ার আসর বসায় প্রায়ই। এসবে বন বিভাগের কোনো নিষেধ না মানায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানে বিষয়টি অবগত করলেও কোনো সুরাহা হয়নি বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বন কর্মকর্তা জানায়। তবে বন বিভাগ থেকে ইউএনওকে জানানো হবে বলে তিনি জানায়।
পার্কের প্রধান গেট এবং ভেতরের বিভিন্ন স্থাপনা বন বিভাগ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে ডেকে নিয়ে তাদের অর্ধেক টাকায় উঠছে না বিধায় তারাও বেশ লোকসানের মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে পার্কের ইজারাদার রিয়াজ অ্যান্ড আসাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইদুর রহমান বাবলু বলেন, আমি ২০ লাখ টাকা দিয়ে ইকো পার্কের ক্যান্টিন, টাওয়ার, লেক, শিশু পার্ক ও মিনি চিড়িয়াখানা ইজারা নিয়ে এখনও তিন লাখ টাকা তুলতে পারিনি অথচ আমার এই ইজারার মেয়াদ আর মাত্র দেড় মাস আছে। বন বিভাগের উদাসীনতার কারণে এখানে বিগত ২৪ বছরে কোনো সংস্কার এবং নতুন কোনো রাইডস বা স্থাপনা তৈরি না হওয়ায় পর্যটকরা আর আসতে চাচ্ছে না।
এন নাহার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমি ইকো পার্কের প্রধান গেটসহ বিভিন্ন স্পট ৬৭ লাখ টাকা দিয়ে ডেকে নিলেও গত ১১ মাসে আমার অর্ধেক টাকাও ওঠেনি। পার্কের কোনো উন্নয়নমূলক কাজ না থাকায় পর্যটকরা এখানে আসতে আগ্রহ হারাচ্ছে বলে জানান তিনি।
ইকো পার্কের উন্নয়নের বিষয়ে ইকো পার্কের দায়িত্বগত মধুটিলা রেঞ্জের রেঞ্জার মো. রফিকুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে চাইনি, তবে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে ইকো পার্কের উন্নয়নের চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এখানের পাহাড়ের মাটির অবস্থা ভালো না বিধায় ধীরস্থিরে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।
এদিকে শেরপুর জেলার সর্ববৃহৎ এ ইকো পার্ক বা পর্যটন কেন্দ্রটির পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবসায়ীরা পার্কের দ্রুত সংস্কার এবং নতুন নতুন স্থাপনা ও রাইডস নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।