নানা জটিলতা পেরিয়ে ২০১৪ সালে শুরু হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। তবে নির্মাণ শুরুর পরও জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে প্রকল্পটি। এ নিয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনা পরামর্শক। তা নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ প্রথম পর্ব
ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণে চুক্তি সই হয় ২০১৪ সালের জুনে। ওই বছর নভেম্বরে চুক্তিটি কার্যকর হয়। তিন বছর হতে চললেও আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি মূল সেতু নির্মাণে। আর নদী শাসন প্যাকেজের অবস্থা আরও খারাপ। ২০১৪ সালের নভেম্বরে চুক্তি সইয়ের পর ডিসেম্বরে তা কার্যকর হয়। উভয় অংশের কাজই ২০১৮ সালে শেষ করার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয় রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এতে বলা হয়, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হতে অতিরিক্ত এক বছর লাগতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি হয়েছে চার দশমিক ১০ শতাংশ। জুন শেষে এ প্যাকেজের ৪৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাত দশমিক ৭৮ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে মূল সেতুর কাজ। তবে এটি বাস্তবিক অগ্রগতির হার নয়। আর্থিক অগ্রগতির ভিত্তিতে এটি হিসাব করা হয়েছে।
এদিকে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত নদী শাসনের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র এক দশমিক ১৫ শতাংশ। জুন শেষে এ অংশের বাস্তবায়ন হার ৩০ দশমিক ২৮ শতাংশ। যদিও এ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে নদী শাসনের কাজ। তবে এটিও বাস্তবিক অগ্রগতির হার নয়। আর্থিক অগ্রগতির ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়েছে।
২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর মূল সেতু নির্মাণে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ব্যবস্থাপনা পরামর্শক মূল সেতুর বাস্তব অগ্রগতি পর্যালোচনা করে। এতে দেখা যায়, ঠিকাদারের বিদ্যমান যন্ত্রপাতি দিয়ে নির্মাণকাজ শেষ করতে অতিরিক্ত এক বছর লাগবে। যদিও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি গত ২৪ এপ্রিল সংশোধিত প্রোগ্রাম জমা দেয়। এতে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে অতিরিক্ত নয় মাস সময় দাবি করা হয়েছে। তবে নির্মাণ তত্ত¡াবধানের দায়িত্বে থাকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস তা ফেরত দিয়েছে। এক্ষেত্রে চুক্তির বিদ্যমান সময়ের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য পুনরায় সংশোধিত প্রোগ্রাম জমা দিতে বলা হয়।
এদিকে প্রকল্পটির নদী শাসনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। তবে প্যাকেজের ঠিকাদার চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন কাজটি শেষ করতে আরও ছয় মাস সময় অতিরিক্ত দাবি করে। যদিও নদী শাসনের বাস্তব অবস্থা যাচাই করা দরকার বলে মনে করছে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক। এক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হয়, প্যাকেজটির বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে কত দিন লাগবে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে এটি করা দরকার।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা হয়েছে। এজন্য মাসভিত্তিক অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তার ভিত্তিতে মাসিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রধান দুটি কম্পোনেন্টই পিছিয়ে আছে। তবে কবে নাগাদ নির্মাণকাজ শেষ হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের তথ্যমতে, মূল সেতুর পাইলিং কমপক্ষে আট মাস পিছিয়ে গেছে। এতে এক বছর পিছিয়ে গেছে পিলার নির্মাণও। আর সেতুটির সুপার স্ট্রাকচার হিসেবে পিলারের ওপর বসানো হবে স্টিলের স্প্যান। তবে পিলার ও পাইলিং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে যাওয়ায় স্প্যান নির্মাণও গতি হারিয়েছে। এগুলো প্রি-ফেব্রিকেশন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চার মাস পিছিয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের শেষ দিকে সেতুটি উদ্বোধনের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে নির্মাণকাজের ধীরগতির কারণে এখন সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বরং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেক সেতু দৃশ্যমান করার লক্ষ্যে এখন কাজ চলছে।
সেতু বিভাগের তথ্যমতে, গত আগস্ট পর্যন্ত মূল সেতুর ২৪০টি পাইলের মধ্যে মাত্র ১৮টির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। আর ১১৪টির নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া ৪০টি পিলারের মধ্যে দুটির (৩৭ ও ৩৮) নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এগুলোর ওপর বসানোর জন্য স্প্যানও প্রস্তুত করা হয়েছে। পিলারের ওপর স্থাপনের জন্য মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়া প্রান্ত থেকে জাজিরা প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তিন হাজার ২০০ টন ওজনের স্প্যানটি। এর আগে গত সপ্তাহে স্প্যানটি ধূসর রঙ করা হয়। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর এটি ৩৭ ও ৩৮নং পিলারের ওপর বসানোর কথা রয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর প্যানেল অব এক্সপার্টের সদস্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এম শামিম জেড বসুনিয়া বলেন, ‘যে যাই বলুক ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে না। তবে পুরোপুরি না হলেও ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ ওই সময়ের মধ্যে শেষ হবে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি গিয়ে এটি শেষ হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, নদীতে স্রোত খুব বেশি। পাইল করা যাচ্ছে না। পদ্মা নদীতে মোট ৪০টি পিলার আছে। এগুলোয় ২৪০টি পাইল হবে। ৭০ থেকে ৮০টি পাইল করতে সময় একটু বেশি লাগবে। স্রোতের কারণে প্রায় ১৪টি পিলার নির্মাণও পুরোপুরি পিছিয়ে যাবে। এছাড়া বাকি কাজ প্রায় প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটির আওতায় মূল সেতু নির্মাণের চুক্তি মূল্য ধরা হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। নদী শাসনের চুক্তি মূল্য আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। জুন পর্যন্ত দুই প্যাকেজের আওতায় ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে পাঁচ হাজার ৪৫৭ কোটি ৬০ লাখ ও দুই হাজার ৬৩৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। যদিও জমি অধিগ্রহণ খাতে এ ব্যয় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
Add Comment