একসময় টিভি খুললে চোখে পড়ত বিটিভির নাটক, ইত্যাদির মতো শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান, দেশীয় সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম, সিসিমপুর। তখন মানুষের মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ ও বিবেচনা শক্তি ছিল এই সময়ে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু এখন এমন একটা সময় চলে এসেছে যখন একটা স্মার্টফোন পুরো পৃথিবীকে হাতের মুঠোতে নিয়ে এসেছে। এখনকার শিশুদের কাছে মীনা কার্টুন, সিসিমপুর বিরক্তিকর। যুগের সঙ্গে রুচি পালটানোটাই স্বাভাবিক কিন্তু যখন তা ‘রুচির অবক্ষয়’-এ রূপ নেয় তখন শঙ্কিত হতে হয়।
সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী পাঁচজন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে একজন সাড়ে চার ঘণ্টার ওপরে ফোন ব্যবহার করে থাকে। এখন ফোনটা খুললেই সস্তা টিকটকারদের রাতারাতি সেলিব্রিটি হওয়ার গল্প, প্রথম শ্রেণির টিভি চ্যানেলে তাদের ডেকে এনে নানা ডাবল মিনিং প্রশ্ন, চারদিকে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। নাটক-সিনেমায় অবাধে মাদকের প্রদর্শনী, ভায়োলেন্স ভরপুর, নারীদের অপ্রীতিকরভাবে উপস্থাপন করা এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অসুস্থ একটা পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রজš§রাও হয়ে যাচ্ছে উ™£ান্ত। তাদের নেই দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি কোনো টান, তারা কেউ হলিউড বা কেউ বিটিএসের ফ্যান, যারা সেলিব্রিটি বলতে চেনে সবচেয়ে নি¤œ রুচির মানুষগুলোকে। এখন এমন একটা পর্যায়ে দেশীয় টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রাম, সিনেমা, নাটক পৌঁছে গেছে যখন মানসিকভাবে সুস্থ কোনো পরিবার একত্রে বসে তা দেখতে পারে না। কাদের শিল্পীর মান দেয়া হচ্ছে, কাদের সেলিব্রিটি বলা হচ্ছে, কাদের আইডল হিসেবে পেশ করা হচ্ছে, তার একটা গভীর প্রভাব আছে, একটা প্রজšে§র মনস্তত্তে¡র ওপর। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল যেন একটা এক গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছে সমাজ থেকে মূল্যবোধ উঠিয়ে নেয়ার জন্য।
আমরা যা দেখি তার সরাসরি প্রভাব আমাদের চিন্তা, ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর পড়ে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী প্রতিনিয়ত সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার মস্তিষ্কের গঠন, কার্যাবলি ও তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে পরিবর্তন করছে (মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও আবেগ)। আর এ ব্যাপারটাকে পুঁজি করে একটা কুচক্রী মহল আমাদের এই দেশের মানুষের বিনোদনের মাধ্যমটাকে বেছে নিয়েছে তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে প্রতিনিয়ত অপরাধ বাড়ছে, বাড়ছে হতাশা ও আত্মহত্যার ঘটনা, ঘরে ঘরে বাড়ছে মাদকাসক্ত ছেলেমেয়ের সংখ্যা। এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
উন্নতির শিখরে উঠতে উঠতে এখন আমরা ‘যত ভিউ ততো টাকা’-এর ধারণায় আমরা চলে গেছি। ভিউ বাড়াতে তাই ইন্টারভিউয়ের জন্য বড় বিজ্ঞানী, অধ্যাপক বা উদ্যোক্তা না নিয়ে নেয়া হয় ইন্টার পাস না করা কোনো এক নারীর যার একমাত্র যোগ্যতা সে ভাইরাল বা কোনো মহিলা যে তার চেয়ে বয়সে বেশি কাউকে বিয়ে করায় আলোচিত, বা কোনো লোক যে মেয়ে সেজে ভিডিও করে, বা কোনো মহিলা যে অশ্লীল-নোংরা কথা কাজ করে তার প্রোডাক্ট বিক্রি করে, আর না হয় কোনো টিকটকার যার নেই কোনো সৃজনশীলতা। সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হলো, এ মানুষগুলো যারা দেশের শিল্প-সাহিত্য বা সংস্কৃতির ইতিবাচক বিকাশে বিন্দুমাত্র ভ‚মিকা রাখে না তাদের রাতারাতি স্টার বানানোর প্রয়াস করছে প্রথম শ্রেণির গণমাধ্যমগুলো। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনের প্রজš§টা হবে বিকৃত যাদের কোনো ধর্মীয়, সামাজিক বা চারিত্রিক মূল্যবোধ থাকবে না, যাদের কাছে সফল মানুষ মানে কোনোভাবে ভাইরাল হওয়া আর অনেক অর্থ উপার্জন করা। তাদের কাছে এটা অপ্রয়োজনীয় মনে হবে ভেবে দেখার যে উপার্জনটা বৈধ নাকি অবৈধ পথে হচ্ছে।
এই অবস্থা থেকে সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা করতে হবে পরিবারকে। সন্তানদের অবাধ টিভি, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ব্যবহারের প্রতি খুবই সতর্কতা প্রয়োজন; কারণ বিশাল একটা গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যই এই প্রজš§কে ধ্বংস করা। পাশাপাশি নিজ সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করা এখন সময়ের দাবি।
জিনিয়া ফেরদৌস জুঁই
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়