অদক্ষ পরামর্শকে ব্যাহত পদ্মা সেতুর নির্মাণ তত্ত্বাবধান

নানা জটিলতা পেরিয়ে ২০১৪ সালে শুরু হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। তবে নির্মাণ শুরুর পরও জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে প্রকল্পটি। এ নিয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনা পরামর্শক। তা নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ দ্বিতীয় পর্ব

 

ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর প্রধান দুই অংশের (মূল সেতু ও নদী শাসন) নির্মাণ তত্তাবধানের দায়িত্বে রয়েছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস (কেইসি)। যদিও প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি পদগুলোতেও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়নি কেইসি। ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণে গুণগত মান ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছে প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনা পরামর্শক।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এতে বলা হয়, নির্মাণকাজের গুণগত মান নিশ্চিতে কেইসির দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, নির্মাণকাজ তত্ত¡াবধানের দায়িত্বে থাকা কেইসির কারিগরি দক্ষ জনবলের চরম ঘাটতি রয়েছে। আর কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে নিজ দেশে কাজ করে থাকে। তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা খুবই কম। তাই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর দায়িত্ব পালনে অনেক ক্ষেত্রেই সক্ষম নয়। এছাড়া পদ্মা সেতুর ঠিকাদার চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মনে করে কেইসির আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা খুবই কম। ফলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন কার্যপ্রণালী প্রণয়ন ও সেগুলোর দ্রæত অনুশীলনে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে পরামর্শকের অদক্ষতার কারণে নির্মাণকাজের গুণগত মান খারাপ হচ্ছে বলে সংশয় প্রকাশ করেছে রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। তারা বলছে, সেতুর সুপার স্ট্রাকচারের জন্য স্টিলের স্প্যান তৈরিতে সঠিক গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না। কারণ স্টিল ট্র্যাস ফেব্রিকেশনে চায়না রেলওয়ে সাংহাই ব্রিজ গ্রæপ কোম্পানি (সিআরএসবিজি) দেশটির সাধারণ অভ্যন্তরীণ মান অনুসরণ করছে। যদিও এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের কথা ছিল। কিন্তু কেইসি এক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তবে সিআরএসবিজিকে ডেকে সতর্ক করেছে সেতু বিভাগ। এছাড়া সেতুর জন্য তৈরি করা প্রথম দুটি স্প্যান রঙের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির ঠিকাদার ও পরামর্শক দলের পরিবেশগত বিশেষজ্ঞ হয়তো নেই অথবা তাদের কার্যক্রম যথাযথভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে পরিবেশগত মানবিষয়ক কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ম্যানুয়াল চ‚ড়ান্ত করা হয়নি। যদিও ঠিকাদারদের আইএসও ৯০০১-২০০৮ অনুসরণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরামর্শকের। এছাড়া ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটির পরিবেশগত বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন দাখিল করেছে, সেগুলোর গুণগত মানও খুব দুর্বল।

কেইসির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির সব ধরনের নির্দেশনা ও কার্যক্রমে প্রকল্প ব্যবস্থাপক তথা টিম লিডারের ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ভরশীল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া প্রিকাস্ট কংক্রিট নির্মাণসংক্রান্ত কারিগরি বিভিন্ন ইস্যু ও চুক্তিসংক্রান্ত বিষয়ে স্বল্প সময়ে নির্দেশনা দিতে কেইসি টিমের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। আবার অন্যান্য ক্ষেত্রেও কর্মী নিয়োগে (যেমন: কোয়ান্টিটি সার্ভেয়ার, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার প্রকৌশলী ও প্রকল্প মনিটরিং স্টাফ) ঘাটতি রয়েছে। এতে প্রকল্পটির কোয়ালিটি কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা, প্রজেক্ট প্রোগ্রাম মনিটরিং ও পরিবেশগত তত্ত¡াবধান দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে কেইসির উচিত গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় দ্রæত অতিরিক্ত ও যথাযথ অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক মানের সাইট সুপারভিশন কর্মী নিয়োগ করা।

জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্ট টিমের সিনিয়র একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তুলনামূলক কম দক্ষ, এটা ঠিক। তবে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক বেশ দক্ষ। তারা এক্ষেত্রে ব্যাকআপ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্যানেল অব এক্সপার্টও নিয়মিত মতামত দিয়ে থাকে। তবে কিছু ঝুঁকি তো থেকেই যায়। কারণ দৈনন্দিন নির্মাণকাজ তত্তাবধানের দায়িত্ব কেইসির।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে আগ্রহ দেখায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে প্রাথমিক দরপত্র যাচাই-বাছাই শেষে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয। এদের আর্থিক প্রস্তাবনা যাচাইয়ের সময় পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরে দরপত্রটি বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালে আবার পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহবান করা হয়। তবে এতে আর পুরোনো কোনো কোম্পানি অংশগ্রহণ করেনি। ফলে তুলনামূলক কম দক্ষ কোম্পানিকেই সেতুটির পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় সেতু বিভাগ।

এদিকে শুরুতেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের টিম লিডারের বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘাটতি ধরা পড়ে। ফলে ছয় মাসের মধ্যে ওই টিম লিডার পরিবর্তন করা হয়। এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় পদ্মা সেতুর নকশা প্রণেতা দলের টিম লিডারকে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পরামর্শক দলের টিম লিডার নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল। এজন্য বেশ আগেই তাকে পরিবর্তন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের অন্যান্য সুপারিশ বিবেচনা করা হচ্ছে। এগুলো অনুসরণে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফলে নির্মাণকাজ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০