রহমত রহমান: মূলধনি যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিতে দেয়া হয়েছে রেয়াতি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা। সুবিধা পেতে শর্ত দেয়া হয়েছে, কনজুমেবল পণ্য আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। প্রতিষ্ঠান মূলধনি যন্ত্রপাতি আর নির্মাণ উপকরণের সঙ্গে আমদানি করেছে বিপুল পরিমাণ পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ। সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান রেয়াতি সুবিধায় এই পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ আমদানি করেছে। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে চারটি চালানে আমদানি করা এ পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশে প্রায় দুই কোটি ২৮ লাখ টাকা শুল্ককর পরিশোধ করেনি সিটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটি। শুল্ককর পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশও জারি করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী কাস্টমস বলছে, পেইন্ট অ্যান্ট ভার্নিশ কনজুমেবল পণ্য, যাতে রেয়াতি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। নিয়ম না মেনেই অবৈধ রেয়াত নিয়েছে প্রতিষ্ঠান; ফলে এই শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে। কাস্টমস নিশ্চিত যে রেয়াতি সুবিধা পাবে না। তবুও মতামতের জন্য এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস। আর সিটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী রেয়াতি সুবিধা পাবে।
এনবিআর সূত্রমতে, চট্টগ্রাম কাস্টম কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান মতামত চেয়ে ৮ নভেম্বর এনবিআরকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০১৫ সালের ২০৯নং এসআরও অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধায় (সিপিসি ৪০০০-২২৮) তিনটি বিল অব এন্ট্রিতে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানি করে। তবে ওই চালানে রেয়াতি সুবিধায় বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল হিসেবে পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ খালাস নিয়েছে।
আরও বলা হয়, সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড অর্থনৈতিক অঞ্চলভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকায় অবস্থিত। অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসআরও-২০৯ সুবিধায় বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানি করা হয়। এই এসআরও অনুযায়ী, শুধু মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং নির্মাণ উপকরণ শুল্কমুক্তভাবে আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান মূলধনি যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ উপকরণ শর্ত সাপেক্ষে আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক ও মূসক অব্যাহতি পেয়ে থাকে। এই এসআরওতে তিনটি শর্ত দেয়া হয়েছে। ২নং শর্তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সহজলভ্য এমন নির্মাণসামগ্রী যেমনÑএমএস রড বা বার, সিমেন্ট, প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং, আয়রন বা স্টিল সিট আমদানিতে এই অব্যাহতি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া ৩নং শর্তে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন এবং নির্মাণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, এমন কোনো পণ্য যেমনÑঅফিস সরঞ্জাম, এয়ার কন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় এবং অনুরূপ অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এই অব্যাহতি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সিটি সিডের আমদানি করা পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ বাংলাদেশে সহজলভ্য ও কনজুমেবল পণ্য বলে বিবেচিত। অর্থাৎ দেশেই এই পণ্য সহজলভ্য। এরপরও প্রতিষ্ঠানটি আমদানি করেছে এবং রেয়াতি সুবিধায় খালাস নিয়েছে। কনজুমেবল পণ্য ও সহজলভ্য হওয়ায় পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশে রেয়াতি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না বলে মনে করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। ফলে এই তিনটি চালানে পেইন্ড অ্যান্ড ভার্নিশে সিটি সিডের নেয়া রেয়াতের টাকা রাজস্ব হিসেবে দাবি
করে সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে। কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। দুই কোটি ২৮ লাখ ৬২ হাজার ২৩০ টাকা আদায়ে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর কাস্টমস আইন, ১৯৬৯-এর ৮৩-এ ধারা অনুযায়ী পৃথক তিনটি কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, আমদানিকারক সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারণ দর্শানোর পর লিখিত জবাব দিয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, সিটি সিড সয়ামিল উৎপাদনের জন্য শিল্প প্লান্ট স্থাপনের লক্ষ্যে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও
সংশ্লিষ্ট পণ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতির রেয়াতি সুবিধা প্রদানের জন্য এনবিআর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি একটি আদেশ জারি করে। সেই তিনটি পণ্য চালানের পিআই হিসেবে এই পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ওই আদেশে ৪৬টি পণ্য, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের কথা উল্লেখ রয়েছে। শর্ত সাপেক্ষে সেই আদেশ জারি করে এনবিআর। এ আদেশে মেশিনের লে-আউট প্ল্যান, দাখিল করা প্রোফরমা ইনভয়েস ও সাপ্লাই কন্ট্রাক্ট বা প্রোফরমা ইনভয়েস অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা পণ্যের (পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ) ক্ষেত্রে রেয়াতি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এইচএস কোডে স্বাভাবিক শুল্ক হারে ওই পণ্যের শুল্কায়ন হবে। ওই আদেশে কনজুমেবল পণ্যকে রেয়াতি সুবিধার আওতাবহির্ভূত করে শর্তারোপ করা হয়েছে।
অপরদিকে, এনবিআর ২০২০ সালের ৪ মার্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনসংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছে। তাতে পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশকে কনজুমেবল পণ্য মর্মে উল্লেখ করেছে। এনবিআরের রেয়াতি সুবিধা-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠানটির প্রোফরমা ইনভয়েসটি অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ কনজুমেবল হওয়ায় রেয়াতি সুবিধা প্রাপ্য হবে না বলে মনে করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এই বিষয়ে এনবিআরের দিকনির্দেশনা চেয়েছে কমিশনার।
তিনটি বিল অব এন্ট্রি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড তিনটি চালান ইন্দোনেশিয়া থেকে পিটি পিপিজি কোটিংস ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করেছে। তিনটি চালানে চারটি কনটেইনারে আমদানি করা পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ ও অন্যান্য পণ্যের গ্রস ওয়েট এক লাখ ৪০ হাজার ৫২ কেজি; যার বেশিরভাগই পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করলে সিটি সিড এই পণ্যে রেয়াতি সুবিধা পায়। তবে এনবিআরের ২০১৫ সালের জারি করা আদেশ অনুযায়ী রেয়াতি সুবিধা পাবে না। আবার ২০২০ সালে সিটি সিডের জন্য এনবিআর যে আদেশ জারি করেছে, তাতেও পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ নেই। পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ যদি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত হয়, যেমন ওই পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ ছাড়া কনস্ট্রাকশন হবে না বা দেশে সেই পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ উৎপাদন হয় না বা নেই, তাহলে রেয়াতি সুবিধা পেতে পারে। তবে পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ দেশে সহজলভ্য বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।
অপরদিকে, পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ কনজুমেবল আইটেম। এসআরওতে না থাকা সত্ত্বেও আপনারা এর ওপর রেয়াতি সুবিধা নিয়েছেন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এনবিআরের কাছে মতামত চেয়েছেÑএই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশে রেয়াতি সুবিধা পাব। ২০২০ সালে এনবিআর যে অর্ডার করেছে, তাতে পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ রয়েছে। সেই অর্ডারে পিআই হিসেবে তালিকায় পেইন্ট অ্যান্ড ভার্নিশ রয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অ্যাসেসমেন্ট কমিটিও আমাদের পক্ষে রয়েছে। তাদের সেই কাগজপত্র আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা তো অনেক আগে শুনানিও দিয়ে এসেছি। নভেম্বরে কাস্টম হাউস থেকে আবার এনবিআরের মতামত চাওয়া হয়েছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিআই হিসেবে তালিকায় রয়েছে। এরপরও কমিশনার মতামত চেয়েছে কেন।