নাজমুল ইসলাম ফারুক: তিন বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের। বিষয়টি স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে না জানিয়ে তথ্য গোপন করেছে প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ। অপরদিকে উৎপাদন না থাকলেও কোম্পানির গত জুন সমাপ্ত বছরে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দেখিয়েছে ও লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাছাড়া বাজার থেকে আরও মূলধনও উত্তোলনের পাঁয়তারা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
উৎপাদন বন্ধ হওয়া কোম্পানি পরপর দুবছর লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর হঠাৎ আয় ও শেয়ারদর ধারাবাহিকভাবে বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
এদিকে গত সোমবার গাজীপুরের মৌচাক কারখানায় সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, চারদিকে সুনসান নীরবতা, সিকিউরিটি গার্ডরা বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। এক সময় যে ভবনে পণ্য উৎপাদন হতো, সেটা নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। নেই শ্রমিকের কোনো আনাগোনা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারখানায় মাত্র চার-পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন সিকিউরিটি গার্ড।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, চার বছর আগে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তিন বছর আগে কোম্পানিটি একটি বড় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ পায়; কিন্তু সেখানেও অনিয়ম হওয়ায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, শুনেছি প্রতিষ্ঠানটির মালিক ব্যাংক থেকে ঋণ ও শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে দেশের বাইরে বিনিয়োগ করেছেন। অন্যদিকে এ কারখানার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
মোস্তফা কামাল নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, কোম্পানির মালিক আমার কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। শুনেছি তিনি নাকি ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা ঋণ এনেও আত্মসাৎ করেছেন। এখন কারখানায় কম আসেন। তিনি বলেন, এক সময় এ কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করতেন, আর এখন নীরব-নিস্তব্ধ।
শুধু কারখানাই নয়, লিগ্যাসির ঢাকা অফিসে মাত্র দুজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতাও বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তারা অন্যত্র চলে গেছেন বলে জানা গেছে।
কারখানার উৎপাদন বন্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোম্পানির ম্যানেজার (অ্যাফেয়ার্স ও শেয়ার) এসএম স্বপন শেয়ার বিজকে জানান, কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়নি। বন্ধ হলে তো আয় হতো না এবং লভ্যাংশ ঘোষণা সম্ভব হতো না বলে জানান তিনি।
এদিকে গতকাল কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ২০১৭ সালের জুনে সমাপ্ত হিসাববছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোম্পানিটি সমাপ্ত বছরে শেয়ারপ্রতি আয় দেখিয়েছে এক টাকা ১১ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি) দেখানো হয়েছে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা। সে সঙ্গে কোম্পানিটির পর্ষদ নতুন করে মূলধন উত্তোলনেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।
কোম্পানিটির ২০১৩ সালে এবং পরের বছর পাঁচ শতাংশ করে লভ্যাংশ দিয়ে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করে। পরের দুবছর লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়ে কোম্পানিটি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থান পায়। তবে এবার ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে স্থান করে নেবে প্রতিষ্ঠানটি। পুনরায় মূলধন উত্তোলন করতে পরপর দুবার ব্যর্থ হয়ে হঠাৎ ক্যাটাগরি স্থানান্তর হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের তিন বছর উৎপাদন বন্ধ; অথচ এ তথ্য গোপন করছে। এটি একটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। তথ্যটি না জানিয়ে প্রতিষ্ঠান আইন লঙ্ঘন করেছে। এ কারণে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উচিত, কোম্পানির উৎপাদন বন্ধের বিষয়টি খতিয়ে দেখা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
উৎপাদন বন্ধের তথ্য গোপন করায় কোম্পানির বিরুদ্ধে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে জানতে চাইলে ডিএসইর প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা (সিআরও) একেএম জিয়াউল হাসান খান শেয়ার বিজকে বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।
জানা গেছে, কোনো কোম্পানি পরিদর্শনের এখতিয়ার নেই স্টক এক্সচেঞ্জের। আর এ সুযোগে অনেক কোম্পানি তাদের মনমতো করেই তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে এ প্রতিবন্ধকতা দূর হলে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক তথ্য জানা ও তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বিষয়টি প্রথম তদারকি করবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। দেখা যাক ডিএসই কি পদক্ষেপ নেয়। পরবর্তীকালে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।
Add Comment