আহমেদ সাঈফ মুনতাসীর ও হামিদুর রহমান : তৃতীয় প্রজন্মের তারবিহীন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি (থ্রিজি) সেবা চালুর পাঁচ বছর হয়ে গেলেও আশানুরূপ গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। সারা দেশে থ্রিজি প্রযুক্তি চালু করার ঘোষণা দিলেও দেশের মোট আয়তনের মাত্র ৬৮ দশমিক ৭১ শতাংশ এলাকা এ নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত রয়েছে। এছাড়া থ্রিজি গতির দিক দিয়েও বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের ৯৫টি দেশের মধ্যে থ্রিজি সেবা চালু আছেম যার মধ্যে গতির দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম।
লন্ডনভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা সংস্থা ওপেনসিগন্যালের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। থ্রিজি ও ফোরজি নেটওয়ার্কের প্রাপ্যতা, প্রদত্ত সার্বিক স্পিড, স্পিডের বিপরীতে ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সময়সীমা ও সহজলভ্যতা এ চার ক্যাটাগরিতে র্যাঙ্কিং করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বের থ্রিজি নেটওয়ার্কের আওতাধীন ৯৫টি দেশের আট লাখ ২২ হাজার ৫৫৬ জনের ওপর জরিপ চলিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের ৯৫টি দেশে থ্রিজি প্রযুক্তি চালু আছে, যার মধ্যে তিন দশমিক ৭৫ এমবিপিএস গতি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ৪১ দশমিক ৩৪ এমবিপিএস গতি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গতির থ্রিজি দেশে পরিণত হয়েছে। ৩১ দশমিক ১৯ এমবিপিএস গতি নিয়ে সিঙ্গাপুরের অবস্থান দ্বিতীয়। অন্যদিকে থ্রিজিতে দুই দশমিক ১৭ এমবিপিএস গতি নিয়ে আফগানিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে কম গতির দেশের সারিতে রয়েছে। এছাড়া পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থান ৭২ ও শ্রীলঙ্কার ৮০। তবে থ্রিজির গতিতে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে নেপাল ও পাকিস্তান। দেশ দুইটির অবস্থান যথাক্রমে ৮৫ ও ৮৭।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ এলাকা থ্রিজি নেটওয়ার্কের আওতায় এনে এ প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। ৯৫ দশমিক ৫২ শতাংশ এলাকা এ নেটওয়ার্কের আওতায় এনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৭৮ দশমিক ৪২ শতাংশ এলাকা থ্রিজি নেটওয়ার্কের আওতায় এনে প্রথম অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, যা বিশ্বের মধ্যে ৬৪তম, ৬৮ দশমিক ৭১ শতাংশ এলাকা থ্রিজি নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশের অবস্থান ৮১তম। অন্যদিকে থ্রিজি নেটওয়ার্ক বিস্তৃতির বিচারে ভারতে ৫৬ দশমিক ১, পাকিস্তান ৬৩ দশমিক ৪৭ ও নেপালের ৫৯ দশমিক ৫০ শতাংশ এলাকা রয়েছে।
বিশ্বের ৯৫টি দেশে থ্রিজি সেবা চালু রয়েছে এবং থ্রিজি গতির দিক থেকে এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। বাংলাদেশে থ্রিজি নেটওয়ার্কের গড় গতি তিন দশমিক ৭৫ এমবিপিএস। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গড় থ্রিজির স্পিড পাঁচ দশমিক ৩০, শ্রীলঙ্কায় চার দশমিক ২৮, পাকিস্তানে তিন দশমিক ৩৩, নেপাল তিন দশমিক ৭৫ এমবিপিএস।
উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে বাংলাদেশে ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর থ্রিজি যাত্রা শুরু করলেও এখন পর্যন্ত গ্রাহকদের সুবিধামতো গতি দিতে পারেনি অপারেটরগুলো। এক সূত্র থেকে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মোবাইল টাওয়ার (বিটিএস) রয়েছে গ্রামীণফোনের। জিপির বর্তমান থ্রিজি বিটিএসের সংখ্যা ১২ হাজার, যা দেশের ৯১ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে থ্রিজির আওতায় এনেছে। রবির নিজস্ব ৩.৫জি বিটিএসের সংখ্যা পাঁচ হাজার ১৯২টি, যা দেশের ২৯ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে এ সেবার আওতায় এনেছে। তবে এয়ারটেলের এক হাজার ৭২০টি বিটিএসের সঙ্গে সমন্বয়ের পর রবির বর্তমান বিটিএসের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। অন্যদিকে বাংলালিংকের থ্রিজি বিটিএসের সংখ্যা আট হাজার ২০০, যা পুরো দেশকে থ্রিজি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় বিটিএস সংখ্যার অর্ধেক।
তবে থ্রিজির সেবা না বাড়ার কারণ হিসেবে মোবাইল অপারেটররা জানিয়েছেন, দেশে এখনও থ্রিজি সেবা ঠিকমতো বেড়ে ওঠেনি; কারণ এ খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা উঠে আসেনি। ফলে থ্রিজি সেবার মান আর বাড়েনি।
গ্রামীণফোনের এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন্সের ডেপুটি ডিরেক্টর সৈয়দ তালাত কামাল শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশে থ্রিজি স্পিড কম হওয়ার একটা উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার আধিক্য। যেমন, ঢাকাতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে যত সংখ্যক মানুষ বাস করে অনেক দেশের রাজধানীতে এত বিশাল জনসংখ্যা নেই। ফলে দেখা যায়, গ্রামে একটা বিটিএস দিয়ে যতটুকু এলাকা নেটওয়ার্কভুক্ত করা যায়, শহরে সেটা পারা যায় না। ফলে শহরে লোড বেশি পড়ে। এছাড়া আমাদের ডেটা ইউজাররা ফেসবুকিং, ভিডিও স্ট্রিমিং ইত্যাদি নির্দিষ্ট কিছু কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ফলে আমাদের ব্যবহারকারীদের কন্ট্যান্টের ধরনটাও নির্দিষ্ট। তাই বড় ধরনের ডেটা ব্যবহারকারী তৈরি হয়নি। এ কারণে থ্রিজি গতি বাড়ানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, অপারেটরদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে ২০১৪ সালে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরেজমিন থ্রিজি সেবা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে একটি সমীক্ষা চালায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) প্রতিনিধিদল। তাদের সমীক্ষাতে দেখা যায়, দেশে ইন্টারনেটের গতি সবচেয়ে বেশি বাংলালিংকের, সবচেয়ে কম গ্রামীণফোনের। বিটিআরসির সে হিসাব অনুযায়ী, বাংলালিংকের থ্রিজি ইন্টারনেটের গতি গড়ে ২ এমবিপিএস পর্যন্ত। রবির গতি এক দশমিক ৯ এমবিপিএস এবং এয়ারটেলের থ্রিজি ডেটার গতি এক দশমিক ২ এমবিপিএস। চার অপারেটরের মধ্যে গ্রামীণফোনের গতি সবচেয়ে কম। বিভিন্ন প্যাকেজে শীর্ষ এ অপারেটরটি ৫১২ কেবিপিএস এবং ১ এমবিপিএস গতি দিচ্ছে। তবে বিটিআরসি থেকে এরপর নতুন করে থ্রিজি সেবা পর্যবেক্ষণে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, থ্রিজি হচ্ছে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধাযুক্ত মোবাইল নেটওয়ার্ক। ২০১২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম কোম্পানি টেলিটকের মাধ্যমে বাংলাদেশে থ্রিজি যাত্রা শুরু করে। এরপর ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দের মাধ্যমে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল তৃতীয় প্রজন্মের এ প্রযুক্তির সেবাদানের লাইসেন্স পায়। এর আগে ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক ছিল ২.৫ জি বা ২.৭৫ জি। সাধারণত মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে প্রযুক্তির প্রজন্মান্তর ঘটে এভাবে ২জি, ২.৫জি, ২.৭৫জি, থ্রিজি, ফোরজি। নেটওয়ার্ককে পরের প্রজন্মে উন্নীত করে স্বল্পমূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া যায়। এ সুবিধার মাধ্যমে বর্তমান মোবাইল ফোন সেবাদাতারা তাদের গ্রাহকদের নিজস্ব এবং অন্য নেটওয়ার্কে কম মূল্যে ভিডিও কলসহ অন্যান্য সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ পায়।
Add Comment