রাজনীতির মূল দর্শন হচ্ছে মানুষের কল্যাণ করা। দলীয় ব্যবস্থার রাজনীতিতে সাধারণত নাগরিকদের কল্যাণ করার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের উদ্ভব ঘটে। একটি বহুদলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। এসব প্রতিশ্রুতি মূলত নাগরিকদের কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে প্রস্তুত করা হয়। যে রাজনৈতিক দলের ইশতেহার মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি কল্যাণকর ও উপযুক্ত মনে হয়, মানুষ তাদের নির্বাচিত করে সরকারে পাঠাবে। এটিই মূলত দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল প্রক্রিয়া। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে পুরো দৃশ্যপট পালটে গেছে বাংলাদেশে। এখানে মূলত রাজনীতির সঙ্গে পুঁজিপতিদের এক গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এর ফলে পুঁজিপতিরা অনেকাংশে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে তারা সম্পদের স্তূপ গড়ে তুলছে।
সম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজনীতির সঙ্গে পুঁজিপতিদের এই সংযোগ ও রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিষয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে যে ব্যবস্থায় রাজনীতি প্রবেশ করেছে তা থেকে এটিকে বের করে আনার কোনো উপায় পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
দৈনিক শেয়ার বিজে গত রোববার ‘সানেমের সম্মেলনে রেহমান সোবহান: পুঁজিপতিদের সম্পদ করার হাতিয়ার এখন রাজনীতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়, দেশে বর্তমানে রাজনীতি পুঁজিপতিদের সম্পদ সংহতকরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ঋণখেলাপি হওয়া একটি বিজনেস মডেলে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সম্পদশালী হওয়ার এক কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন একশ্রেণির পুঁজিপতি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের খেলাপি ঋণের চিত্র বিশ্লেষণ করলে উপরিউক্ত এ বক্তব্যের সত্যতা মেলে বৈকি। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি প্রভাবশালী। এমনকি গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৯১ জনই ব্যবসায়ী। এসব ব্যবসায়ী তাদের নিজেদের স্বার্থের পক্ষে ইতিবাচক আইন ও নীতি প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর খেলাপি হয়ে থাকছেন। আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ বিদেশে পাচার করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে অনেক ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে। এছাড়া প্রভাব বিস্তার করে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার নজিরও রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে দেখা যায়, রাজনৈতিক সংযোগ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের অর্থ তছরুপের একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। একটি টেকসই অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে এক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ করার ক্ষেত্রে আইনি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।