জাজিরা প্রান্তে বসল পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান

নিজস্ব প্রতিবেদক: ১৯৯৮ সালে প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় পদ্মা সেতু নির্মাণের। সেজন্য প্রাক্-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে সেতু বিভাগ। নানা জটিলতায় এরপর পেরিয়েছে প্রায় ২০ বছর। অবশেষে দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতুর কাঠামোর প্রথম অংশ। জাজিরা প্রান্তে বসানো হলো প্রথম স্প্যান। নির্মাণ শুরুর প্রায় তিন বছর পর গতকাল বসল স্প্যানটি।

গতকাল সকাল সোয়া ১০টার দিকে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর স্প্যানটি বসানো হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে স্প্যান বসানোর কাজ তদারকি করেন।

তথ্যমতে, পদ্মা সেতুতে ৪২টি পিলারের ওপর মোট ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। গতকাল প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়। চীনে তৈরি এ স্প্যানটি খোলা অবস্থায় জাহাজে করে সমুদ্রপথে দেশে আনা হয়। সেখান থেকে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে নিয়ে তা ফিটিং করা হয়। এরপর ধূসর রং করা হয় ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্প্যানটি। আর তিন হাজার ৭০০ টন ওজনের একটি ভাসমান ক্রেন দিয়ে মাওয়া থেকে জাজিরা প্রান্তে এটিকে টেনে নেওয়া হয়।

গত রোববার মাওয়া থেকে যাত্রা শুরু করে সোমবার সকালে জাজিরায় ৩১ নম্বর পিলারের সামনে স্প্যানটি পৌঁছে। সেখান থেকে আবার ড্রেজিং করে শুক্রবার ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের কাছাকাছি ক্রেনটি নেওয়া হয়। বেলা ২টার দিকে ক্রেন দিয়ে খুঁটির ওপরে স্প্যান তোলার কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যার দিকে এক মিটার ব্যবধানে স্প্যানটি পিলার বরাবর তুলে ঝুলিয়ে রাখা হয়। গতকাল সকাল ৮টা থেকে আবার কাজ শুরু হয়। ৯টার দিকে নাটবল্টু স্প্যানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে স্প্যানটি পুরোপুরি পিলারের ওপর স্থাপন করা হয়।

স্প্যান বসানোর পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতুর দীর্ঘ পথপরিক্রমার একটি মাইলফলক এ স্প্যান বসানো। তবে যিনি এর কুশীলব, যিনি এর রূপকার, তিনি এখানে অনুপস্থিত। যদিও প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে এটি স্থাপনের কথা ছিল। তবে ওয়াশিংটন থেকে তিনি জানিয়েছেন, এক মিনিটের জন্য পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করা যাবে না। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তোমরা পারবে।’

তিনি আরও বলেন, প্রথম স্প্যান বসানো সম্পন্ন হলো। পর্যায়ক্রমে বাকি ৪০টি স্প্যানও স্থাপন সম্পন্ন হবে। আর নির্মাণ শেষে এটি যথাসময়ে সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ১৪ পিলারের নকশা পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কারিগরি বিষয়। এজন্য আন্তর্জাতিক অনেক পরামর্শক কাজ করেছেন। সব ঝামেলা মিটিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। এতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে এখন শুধু নির্মাণের পালা।

প্রসঙ্গত, স্প্যান মূলত দুই তলাবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর কাঠামো। এর নিচতলা দিয়ে নির্মাণ করা হবে ব্রড গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ। আর ওপর তলা দিয়ে নির্মাণ করা হবে চার লেনের সড়কপথ। তিন হাজার ২০০ টন ওজনের পুরো স্প্যানটি স্টিলের তৈরি।

সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, সেতুর দ্বিতীয় স্প্যানটি অক্টোবর মাসের শেষের দিকে স্থাপন করা হতে পারে। এর আগে ৩৯ নম্বর পিলার নির্মাণ শেষ করতে হবে। বর্তমানে এটির কাজ চলছে। পাশাপাশি ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের পাইলিংও শেষের পথে। আর ১০টি স্প্যান এরই মধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে, যার মধ্যে সাতটি প্রস্তুতের কাজ চলছে। আরও ১২টি চীন থেকে শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

বর্তমানে মূল নদীতে ১৬টি খুঁটি নির্মাণের কাজ চলছে। আর ২৪০টি পাইলের মধ্যে ১৭ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৬৮টি বসানোর কাজ চলছে। এগুলো ৯৬ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হচ্ছে। এছাড়া জাজিরা ভায়োডাক্টের (উড়ালপথ) ১৯৩টি পাইলের মধ্যে ১৮৬ ও মাওয়া ভায়োডাক্টের ১৭২টির মধ্যে সাতটি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। পাইল বসানোর জন্য দুই হাজার ৪০০, এক হাজার ৯০০ ও এক হাজার টনের তিনটি হ্যামার আনা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। তাতে খরচ ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। এ কাজের খরচ ধরা হয় আট হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এছাড়া দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। তবে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও জমি অধিগ্রহণে ব্যয় আরও এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

এদিকে পদ্মা সেতুর ১৪টি পিলারের পাইলের ১১০-১২০ মিটার গভীরে কাদার স্তর রয়েছে। এজন্য পাইলের নকশা পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে নির্মাণকাজ কিছুটা বিলম্বিত হয়ে পড়েছে। ফলে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না প্রকল্পটির কাজ।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রাক্-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। আর প্রথম দফা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০০১ সালে। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালে এর বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনা করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। ২০০৬ সালে সেতুটির জন্য জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। আর ২০০৮ সালে প্রথম দফা প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়।

২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সেতুটির বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তহবিলে। ২০১১ সালে দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সেতুটি অর্থায়নে চুক্তিও সই হয়। পরে তা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বন্ধ হয়ে যায়। পরে প্রস্তাব অর্থায়ন প্রস্তাব বাতিল করে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে নিজস্ব অর্থে এটি নির্মাণে চুক্তি করা হয়। আর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

 

 

 

 

 

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০