রাজধানীর যানজট হ্রাসে নিশ্চয়ই কিছু করার রয়েছে

ড. আর এম দেবনাথ: -দশ দিন আগে দৈনিক শেয়ার বিজে মালয়েশিয়ার বহুল আলোচিত ‘সেকেন্ড হোম প্রকল্প’ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এতে প্রকল্পটির বিস্তারিত খবর যেমন আছে, তেমনি আছে কয়েকজন বাংলাদেশির কথা যারা ওই প্রকল্পের সুবিধা নিতে চান। এর মধ্যে আছেন একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছেন, সরকারের ধারেকাছের লোক না হলে এদেশে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি সবকিছু গুটিয়ে পরিবারসহ মালয়েশিয়া চলে যেতে চান। এটি বড়ই শঙ্কার খবর। এরচেয়েও শঙ্কার খবর ছাপা হয়েছে গত সপ্তাহে প্রায় সব সংবাদপত্রে। খবরে বলা হয়েছে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কথা। কারা ভাঙছেন? ভাঙছে সরকারি বড় কর্মকর্তাদের গাড়ি। এতে আছে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিবসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তার গাড়ি। সচিত্র ছবিও ছাপা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে এসব প্রভাবশালী কর্মকর্তার গাড়ি রাস্তার নিয়ম-কানুন মানে না। তাদের গাড়ি চলে উল্টোপথে। যাওয়ার কথা বাম দিক দিয়ে। তারা চলেন ডান দিক দিয়ে। এতদিন ট্রাফিক পুলিশ তা চেয়ে চেয়ে দেখেছে; কিন্তু কেন জানি হঠাৎ পুলিশ এ আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। আমরা এতদিন এ আইন ভঙ্গের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি; কিন্তু প্রমাণাভাবে বলতে পারিনি, এসব গাড়ি কার? এখন বলা যাচ্ছে এসব আইন ভঙ্গকারী গাড়ির মালিক সরকারি কর্মকর্তা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাদের সঙ্গে রয়েছে প্রভাবশালী লোকজনও। এ অবস্থায় কী বলা যায়? সরকারের ধারেকাছের লোক না হলে ব্যবসা করা যায় না। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারি লোক হলে আইন ভঙ্গ করা যায় পুলিশের সামনে, প্রকাশ্যে। বলা বাহুল্য, এ সমস্যার সমাধান দরকার। দরকার আইনের শাসনের খাতিরে। নতুবা বহু লোক বিদেশে পাড়ি জমাবে। এটা একধরনের রোগ বা সমস্যা বা লক্ষণ। ট্রাফিক সমস্যার অবশ্য আরেকটি দিকও রয়েছে, আর সেটা হচ্ছে যানজট। যানজটই যে মানুষকে আইন ভাঙতে উৎসাহিত করছে এটা বাস্তব সত্য। যদিও এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধটা করছেন প্রভাবশালীরা। অন্যরা সাহস পান না। এ কারণেই মনে হয় রাস্তায় এখনও কিছু শৃঙ্খলা আছে। অধিকাংশ মানুষ দেশের আইন মানে, রাস্তার আইন মানে। তাই বলে তো দিনের পর দিন যানজটের করুণ অবস্থা চলতে পারে না। যানজট দূর হবে বলে আশা করা হয়েছিল। ঢাকা শহরে অনেকগুলো ওভারপাস/ওভারব্রিজ হয়েছে। ফুটপাত ভেঙে নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। এতে আশা ছিল যানজট কিছুটা হলেও লাঘব হবে; কিন্তু এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে উত্তরা ও টঙ্গী অঞ্চলেই লেগে যায় দু-তিন ঘণ্টা। মাইলের পর মাইল গাড়ি আর গাড়ি! মজার বিষয়, বেশিরভাগই প্রাইভেট কার, জিপ-জাতীয় গাড়ি। বাস কোথায়? ১৯৯০ সালের দিকে চাইলে মতিঝিল থেকে একজন কর্মকর্তা উত্তরা গাড়ি করে যেতে পারতেন। দুপুরের খাবার সেরে আবার অফিসে ঠিক সময়ে আসতে পারতেন। কোনো অসুবিধা হতো না। মতিঝিল থেকে পুরান ঢাকার বাড়িতে গাড়িতে গিয়ে লাঞ্চ করে আবার অফিসে আসা যেত। এসব কী আজ সম্ভব? নিশ্চয়ই নয়। ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে এখন এক, দুই, তিন ঘণ্টা পর্যন্ত লাগে। ‘ভিআইপি মুভমেন্ট’ হলে তো উপায় নেই!  এতে ঘটে এক অসহনীয়-অবর্ণনীয় পরিস্থিতি! দিনের পর দিন ধরে চলছে এটা। কোনো প্রতিকার আছে বলে মনে হয় না। পাঁচ-দশ মিনিটের রাস্তায় লাগে এক ঘণ্টা। সচিবালয়ের মোড়ে ভিড় লেগেই আছে। গুলিস্তানের জ্যাম আদি ও অকৃত্রিম। মৎস্য ভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল হাসপাতাল, সেখান থেকে হেয়ার রোড হয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এসব রাস্তা রীতিমতো নরক। সকাল-বিকাল কখনও এসব রাস্তা খালি নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল হাসপাতাল থেকে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে ধানমন্ডি যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা কী আছে? ধানমন্ডি তো আরেক নরক! গুলশান-বনানীও তাই। উত্তরা ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের পথ ধরেছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এমন একটা অবস্থায় আমাদের থাকতে হবে, তা কি কেউ ভেবেছিলেন? সময় নষ্ট, তেল নষ্ট, ধৈর্য নষ্ট। অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি। বলা যায় অর্থনীতির রক্তক্ষরণ এটা। এর কি কোনো সমাধান নেই? এ ব্যাপারে কারও কি করণীয়, দায়িত্ব বা জবাবদিহিতা নেই? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

সমস্যা সমাধানের আগে সমস্যা চিহ্নিতকরণ জরুরি। সমস্যাগুলো কী? বলা হচ্ছে, ঢাকা শহরের রাস্তা সরু। যে পরিমাণ রাস্তা থাকা দরকার, সে পরিমাণ রাস্তা নেই আমাদের। উত্তর-দক্ষিণে যাতায়াতের ‘আউটলেট’ আছে; কিন্তু শহরে পূর্ব-পশ্চিম করার মতো রাস্তা নেই। আবার বলা হচ্ছে গাড়ির সংখ্যা বেশি। অনেক পরিবারে নাকি ডজনের মতো গাড়ি রয়েছে! তাই বলা হচ্ছে, গাড়ির সংখ্যা সীমিত করা হবে। গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যার যখন যেটা খুশি, তাই বলা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা যে গভীরে ছিল, সেখানেই আছে। কিছুদিন আগেও ফুটপাত দিয়ে হাঁটা যেত না। মোটরসাইকেলওয়ালারা ফুটপাত দিয়ে যেতেন। এ সমস্যার একটা সমাধান হয়েছে হয়তো। ফুটপাতে জায়গায় জায়গায় খুঁটি বসিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করা হয়েছে; কিন্তু এ ব্যবস্থা এসেছে অনেক দেরিতে। ধরা যাক রিকশার কথা। হাজার হাজার রিকশা রাস্তায়। কতগুলো রিকশা ঢাকায় আছে, তা কেউ বলতে পারবেন না। এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণ কে করবে? মতিঝিলে পর্যন্ত রিকশা চলে সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে। খালি রিকশা যাত্রীবিহীন অবস্থায় সারা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাড়ার নিয়ন্ত্রণ বা চলাচলের নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা আইন-কানুন কিছুই মানে না। বেপরোয়া এ রিকশা গমনাগমনে কোনো প্রতিরোধক নেই। ট্রাফিক সিগন্যাল আছে; কিন্তু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ হয় হাতে। সিগন্যাল ব্যবস্থা অচল। সারা বছর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, কাটাকাটি চলছে। এ মুহূর্তে সারা শহর খোঁড়াখুঁড়ির শিকার। ট্রাফিক জ্যাম নিত্যসঙ্গী। হকাররা ফুটপাত দখল করে আছে। ভ্যানগাড়ি, ঠেলাগাড়ি রাস্তার ওপরে। দোকানদাররা রাস্তা দখল করে মালামাল রাখছেন। শান্তিনগরের প্রধান রাস্তায় ডজন ডজন পরিবহনের গাড়ি দিন-রাত পার্ক করে আছে। এসব দেখার কেউ নেই। নবাবপুর রোড দোকানদাররা দখল করে আছেন। গুলিস্তান হকারমুক্ত হচ্ছে না। হাইকোর্ট একবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, নর্থসাউথ রোড হকারমুক্ত করতে। সে সময় আমি কতবার মুহূর্তের মধ্যে পুরান ঢাকায় গিয়েছি আর ফিরেছি। এখন আবার সে আগের অবস্থা। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশ বহাল আছে। ট্রাফিক পুলিশ এখন আর কথা বলে না। বায়তুল মোকাররম, হাউজবিল্ডিংয়ের আশপাশ হকারমুক্ত করা হয়নি আজও। সারা ঢাকা শহরে তাদের উৎপাত, ঠেলাগাড়ি-ভ্যানগাড়ির উৎপাত। এসব বন্ধে কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না। ব্যবস্থা নিলেও কার্যকর হয় না। প্রতিবাদ চারদিকে। গোলাগুলি পর্যন্ত চলে। অথচ এসব অবৈধ কাজ বন্ধ না করে অবলীলায় বলা হচ্ছে, গাড়ির সংখ্যা বেশি; রাস্তার পরিসর কম প্রভৃতি। আমরা যেসব সমস্যা দেখছি, এসব তো বাস্তব। এর সমাধান প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে। ঢাকা শহরকে ‘তিলোত্তমা’ করব, অথচ নাগরিকরা শহরে চলাচল করতে পারবে না এটা তো কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এত বড় শহর; কিন্তু তার ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’কোথায়? যে কোনোদিন যে কোনো বড় ও ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি রাস্তার দিকে তাকান, তাহলে একটা জিনিস পরিষ্কারভাবে ধরা পড়বে রাস্তায় বাসের সংখ্যা খুব কম, প্রাইভেট কার আর জিপই বেশি। স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও কেন আমরা বাস সার্ভিস গড়ে তুলতে পারিনি? যা কিছু গড়ে উঠেছে, তা বেসরকারি খাতে। সরকারি গাড়ি খুবই কম। ফলে যাত্রীরা নিত্য শোষিত। ভাড়ার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সময়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কত কথা শুনলামÑঢাকা শহরে হাজার হাজার বাস নামানো হবে। কই সেসব? এ কথা তো ঠিক, মানুষ যদি বাসে সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারত, তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমে যেত। মধ্যবিত্তরা আজকাল বিপদে পড়ে ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন। রিকশাওয়ালারা আজকাল ভাড়া বিষয়ে রীতিমতো অত্যাচার করেন। বিশেষ করে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী ও তাদের মহিলা অভিভাবকদের সঙ্গে। এসব হতো না, যদি বাস সার্ভিস থাকত। শহরের বড় বড় মোড়ে ‘সিএনজি’ স্টপ থাকতে পারত। পাঁচ-ছয়জন যাত্রী নিয়ে তারা এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে যাতায়াত করতে পারত। সে ব্যবস্থা নেই। ধরা যাক মতিঝিল থেকে নিউমার্কেট, নিউমার্কেট থেকে মিরপুর-১০ অথবা মতিঝিল থেকে এয়ারপোর্ট। এসব হলে একটু সুবিধা ভোগ করে মধ্যবিত্তরা এক জায়গা থেকে অন্যখানে যেতে পারত। এসব না করে আমরা ঝুঁকেছি প্রাইভেট কারের দিকে। সরকার কেন পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করতে পারছে না, তার কোনো ব্যাখ্যা পাইনি। অথচ ?পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ছাড়া আধুনিক শহরে বাস করা অসম্ভব। ‘ওভারপাসে’ এখন অন্তত দুটো সুবিধা পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ বা নরসিংদী অঞ্চলে যেতে আগে সায়েদাবাদে যে ভোগান্তি হতো, এখন তা আর তেমন নেই। দৃশ্যমান এ সুবিধা কতদিন থাকবে তা অবশ্য বিবেচ্য বিষয়। শোনা যায়, পাতাল রেল হবে। মাস ট্রানজিট পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। হোক এসব। কিন্তু এসব তো দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। নিত্যদিনের যানজট নিরসনের ব্যবস্থা কী? ট্রাফিক ব্যবস্থা কি আরও দক্ষ হতে পারে না? এটা কি কোনোভাবেই সম্ভব নয়? আদালত আদেশ দিলে পুলিশ যদি দক্ষ যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে ও তা বেশ কিছুদিন অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে স্বাভাবিক সময়ে তা পারবে না কেন এটা বোধগম্য নয়। মনে হয়, ঢাকা শহরের যানজট সমস্যা সমাধানে কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেই। থাকলে দিনের পর দিন এ অবস্থা চলতে পারত না। শিশুদের চার ঘণ্টা স্কুলে আর চার ঘণ্টা রাস্তায় কাটাতে হতো না। যানজটে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। আমরা সাত শতাংশের বেশি হারে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। লক্ষ্যমাত্রা আরও বেশি। সারা বিশ্বের ব্যবসায়ীরা আসবেন, পর্যটকরা আসবেন; বস্তুত আসছেও। আর তারা খবর পাচ্ছেন ঢাকা শহর রয়েছে বিশ্বের অবাসযোগ্য শহরের শীর্ষে। এটা কোনো সুখবর নয়; বরং লজ্জার। আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রফতানি বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, মাতৃমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শতভাগ স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রশংসাযোগ্য পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে ব্যর্থ হব কেন? মনে হয় জবাবদিহির অভাব। ছোট যেসব সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়, আমরা সেদিকে নজর না দিয়ে বড় সমস্যার দিকে নজর দিচ্ছি বেশি। গা-ছাড়া ভাব সর্বত্র। এখান থেকে মুক্তি দরকার। ট্রাফিক সিগন্যাল চালুকরণ, হকারমুক্ত ফুটপাত নিশ্চিতকরণ, দোকানদারদের জায়গা দখল বন্ধকরণ, উল্টোপথে গাড়ি চালনা বন্ধকরণ, পার্কিং নিয়ন্ত্রণ, ভিআইপি মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ, প্রাইভেট কার ও জিপ নিরুৎসাহিতকরণ এসব কী অসম্ভব? যানজটের এসব ছোটখাটো কারণের প্রতি নজর দিন। তাহলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে বলে মনে হয়।

 

অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০