রহমত রহমান: ফ্রি হুইল ও স্প্রোকেট। এ দুটি যন্ত্রাংশ বাইসাইকেল, রিকশা ও অটোরিকশার অন্যতম যন্ত্রাংশ, যার সঙ্গে চেইন যুক্ত থাকে। আর এর মাধ্যমে বাইসাইকেল, রিকশা ও অটোরিকশার চাকা ঘুরানো যায়। দেশে প্রতিবছর বিভিন্ন আকারের ৩৫ থেকে ৪০ লাখ ইউনিট ফ্রি হুইল ও ৫০ থেকে ৫৫ লাখ ইউনিট স্প্র্রোকেটের চাহিদা রয়েছে, যার বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে। চাহিদা বিবেচনায় বতর্মানে দেশে এই দুটি যন্ত্রাংশ উৎপাদন হচ্ছে।
তবে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে দেশে উৎপাদিত এই দুটি পণ্য টিকতে পারছে না। কারণ একদিকে আমদানি করা পণ্যের দাম কম, অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত পণ্যের ব্র্যান্ড পরিচিতি কম। আমদানির বিকল্প হিসেবে দেশে উৎপাদিত এ দুটি যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ককর বৃদ্ধি করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। সম্প্রতি এনবিআরকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন আকারের ৩৫ থেকে ৪০ লাখ ইউনিট ফ্রি হুইল এবং ৫০ থেকে ৫৫ লাখ ইউনিট স্প্রোকেটের চাহিদা রয়েছে, যার প্রায় ৯০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। চীন ও ভারত থেকে এই দুটি যন্ত্রাংশ আমদানি করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে দেশের তিনটি কোম্পানি এই যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান হলোÑআজিজ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আরএফএল লিমিটেড ও সিরাজ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি। তিনটি প্রতিষ্ঠানই দেশের প্রায় এক কোটি ইউনিটের ফ্রি হুইল ও স্প্রোকেট উৎপাদন করবে। এর মধ্যে আজিজ সাইকেল তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত শুরু করেছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০ লাখ ইউনিট ফ্রিহুইল এবং ৬০ লাখ ইউনিট স্প্রেকেট। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করবে। তিনটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করলে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। তবে এই দুটি যন্ত্রাংশের আমদানিকে দেশীয় শিল্পের বিকাশে বাধা মনে করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।
ট্যারিফ কমিশন ও উদ্যোক্তাদের হিসাব অনুযায়ী, ফ্রি হইল ও স্প্রোকেটের উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে এইচ আর শিট। আর সহযোগী কাঁচামাল হচ্ছে পল, স্প্রিং, স্টিল বল, পলিশিং কেমিক্যাল ও রং। এসব কাঁচামাল আমদানিতে ৩৪ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ৫৬ দশমিক শূন্য চার শতাংশ পর্যন্ত শুল্ককর দিতে হয়। অথচ ফ্রি হুইল আমদানিতে মোট শুল্ককর ৪৪ শতাংশ (কাস্টমস ডিউটি ১৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর পাঁচ শতাংশ ও আগাম কর পাঁচ শতাংশ)।
কমিশন বলছে, এ দুটি যন্ত্রাংশ উৎপাদনে স্থানীয় মূল্য সংযোজন প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার এবং পূর্ণ যন্ত্র আমদানিতে বিদ্যমান যে শুল্কহার, তা স্থানীয় এ উৎপাদনকারীর মূল্য সংযোজন বিবেচনায় যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করে না। স্থানীয় উৎপাদনকারী ছোট শিল্পসমূহের শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ না থাকায় আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে সক্ষমতা হারাচ্ছে। ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীর উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা যথাযথ ব্যবহার করতে না পারায় একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে। বাইসাইকেল ও রিকশার স্পেয়ার পার্টস এবং ফ্রি হুইলকে মধ্যবর্তী পণ্য বিবেচনায় বিদ্যমান আমদানি শুল্ক যথাযথ মনে হলেও বাইসাইকেল ও রিকশার উৎপাদনকারী শিল্পের পশ্চাৎপদ শিল্প (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) হিসেবে স্থানীয় এই শিল্পকে টায়ার, টিউব ও রিম উৎপাদনকারী শিল্পের মতো নির্দিষ্ট মেয়াদে সুরক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। অর্থাৎ এই শিল্প বিকশিত হলে চাহিদার জোগান দিতে
পারছে। আমদানিনির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং রপ্তানি সক্ষমতা অর্জন করবে এই শিল্প। সরকার দেশীয় টায়ার, টিউব ও রিম উৎপাদনকারী শিল্প সুরক্ষায় আমদানিতে ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ শুল্ককর আরোপ করেছে।
ট্যারিফ কমিশন ফ্রি হুইল ও স্প্রোকেটের উৎপাদন শিল্পকে শিশু শিল্প বলছে। ফলে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন আইন, ২০২০-এর ৭(২) ধারা অনুযায়ী শুল্ক সুরক্ষা আইন, ১৯৫০-এর আলোকে শিশু শিল্পকে সুনির্দিষ্ট মেয়াদে সুরক্ষা দেয়ার বিধান রয়েছে। সেজন্য এই শিশু শিল্পকে সুরক্ষা প্রদানের সুপারিশ করা কমিশনের দায়িত্ব। সেজন্য ফ্রি হুইল আমদানিতে বর্তমান আমদানি শুল্ক ৪৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। অর্থাৎ কাস্টমস ডিউটি ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ, তিন শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি ও ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কারোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের এক সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার দেশে আমদানির বিকল্প শিল্প স্থাপন এবং এসব শিল্পের সুরক্ষায় সব ধরনের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। বাইসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশা, টায়ার, টিউব ও রিম দেশে উৎপাদনে স্থানীয়ভাবে ও আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেয়ায় এসব খাত দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। শুধু উৎপাদন নয়, রপ্তানিও হচ্ছে। তবে ফ্রি হুইল ও স্প্রোকেট নামের দুটি যন্ত্রাংশ উৎপাদনে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছে। উৎপাদন শুরু হয়েছে। এই দুটি খাতকে সুরক্ষা দিতে ও আমদানি নিরুৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নেবে এনবিআর।