মানব পাচার বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা চাই

অবৈধ মানব পাচার, বিশেষত নারী ও শিশু পাচার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অন্যতম একটি সমস্যা। বাংলাদেশেও এটি দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। উন্নত জীবনমানের আশায়, বিয়ের প্রলোভনসহ বিভিন্ন কারণে সাধারণ মানুষ ও নারীরা মানব ও নারী পাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের পাঁচ লাখ নারী ভারত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদিসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির জরিপ বলে, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে ভারতের মুম্বাই, দিল্লি ও চেন্নাইয়ের মতো শহরে কাজ পাইয়ে দেয়ার নামে গ্রামের সাধারণ বিভিন্ন বয়সী নারীদের নিয়ে আসা হচ্ছে। সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় সীমানায় পা রাখার পরই দালালদের খপ্পরে পড়ে এসব নারীরা। মুহূর্তেই হাত বদল হয়ে বিক্রি হয়ে যায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ‘রেড জোন’ বা নিষিদ্ধপল্লিতে। মানব পাচারের এই চক্রের খপ্পর থেকে আধিবাসীরাও মুক্ত নন। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে প্রায় ৪৫০ আদিবাসী নারী পাচারের শিকার হয়েছেন।

মানব পাচার চক্র উন্নত চাকরি ও অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে আর্থিকভাবে অসচ্ছল নারী ও পুরুষদের পাচার করে দিচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আবার অনেক সময় অবৈধ পথে অল্প টাকায় বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়ার নাম করে মানব পাচারকারীরা জিম্মি করে দাবি করে মুক্তিপণ। মুক্তিপণের অর্থ না পেয়ে জিম্মি হত্যা করার দৃষ্টান্তও কম নয়।

বাংলাদেশে প্রতিবছর মানব পাচার নিয়ে অসংখ্য মামলা হলেও বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে অধিকাংশ মামলা। আবার নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় বহুলাংশেই আসামিদের খালাস পেতে দেখা যায়। আবার কখনও মানব পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশের সখ্য বা তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কথাও শোনা যায়।

মানব পাচার মামলায় আসামি খালাস হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলীর বলেন, মানব পাচারের মামলা পুলিশের কাছে খুবই লাভজনক মামলা। তদন্ত কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী ও আসামি উভয় পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তদন্ত দীর্ঘদিন আটকে রাখেন। আবার মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হয় না। তারা ভুক্তভোগীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আপস-মীমাংসা করে ফেলে। ফলে আসামিদের শাস্তি হয় না।

অন্যদিকে মানব পাচারের মামলাকারীদের উলটো হেনস্তার খবরও জানা যায়। সাভারের ভুক্তভোগী এক নারীর বাবা ও মামলার বাদী আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভারতে গিয়ে আমার মেয়ে সাত মাস জেল খাটল। আমি মামলা করার পর আসামিরা উলটো আমার বিরুদ্ধে সাভার থানায় ভুয়া মামলা করে। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আমিও চার মাস জেল খাটলাম। পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাবা-মেয়ে জেল খেটেছি। এখন শুনছি আমার মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে।’

বিভিন্ন কারণে মানব পাচারের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার ফলে দেশে ধীরে ধীরে মানব পাচার বেড়েই চলেছে। মানবপাচার বিষয়ক মার্কিন প্রতিবেদন ইউএস ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) রিপোর্টে বাংলাদেশকে গত বছর এবং তার আগের বছরের মতো এ বছরও দ্বিতীয় ধাপে বা টায়ার-২ এ রাখা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার দূর করতে ন্যূনতম মান পূরণ করতে পারেনি। তবে এ লক্ষ্যে তারা উল্লেখযোগ্য চেষ্টা চালিয়েছে।

সরকার ও প্রশাসনের উচিত মানব পাচারের বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। এক্ষেত্রে দল, মত, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্বিশেষে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া যেসব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের বিষয়েও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। আর বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ও মামলার বাদীপক্ষকে হেনস্তার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

আবদুর রহিম

শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০