নিজস্ব প্রতিবেদক: ভাতা বাড়ানো, বকেয়া ভাতা পরিশোধসহ চার দাবিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। গত রোববার থেকে এ কর্মবিরতির মধ্যে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খুব জরুরি না হলে অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। গতকাল সোমবার শিশু বহির্বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই। সব মিলিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনো ওটি হচ্ছে না গতকাল থেকে। আউটডোর থেকে রোগীও পাঠাচ্ছে না। আমরা বসে আছি।’
ভাতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে রোগীদের সেবা দেয়ার। কিন্তু একজন চিকিৎসক যখন চিন্তায় থাকে যে বাসায় খাবারের টাকা নাই, বাসায় বাচ্চার ডায়াপার নাই, বাসা ভাড়া দেয়ার টাকা থাকে না, তখন সে কীভাবে চিকিৎসা দেবে? আমাদের ইন্টার্নশিপে ১৫ হাজার টাকা দেয়, ওই টাকায় কী হয়। অনেক ইন্টার্নকে বাসায় টাকা দিতে হয়। এ অবস্থায় আমরা কোথায় যাব?’
এ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে চারটি পালায় ৫০ জন ইন্টার্ন এবং ৩০ জন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি কাজ করেন। সোমবার সকাল থেকে তারা কেউ কাজে যোগ দেননি।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘এত চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের হাসপাতালে রোগী রিসিভ করেন ইন্টার্নরা। আর ইনডোর রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার মূল ওয়ার্কফোর্স পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনিরা। যদি একসঙ্গে দুইশ জন চিকিৎসক কাজে না আসে তাহলে তো প্রভাব অবশ্যই পড়ে।’
ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বাড়ানো, বকেয়া ভাতা পরিশোধসহ চার দাবিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মবিরতি শুরু করেন। এসব দাবি নিয়ে চিকিৎসকরা গত বছরও আন্দোলনে নেমেছিলেন। এবারে চার দফা দাবিতে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন করেন চিকিৎসকরা। পরে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে দাবি পূরণের আশ্বাস দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন; রোববার পর্যন্ত সময় চান তিনি।
কিন্তু এরপরও কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. জাবির হোসেন বলেন, ‘কবে নাগাদ সমাধান আসবে সে বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা আমাদের ভাতা কত বাড়ানো হবে সেই সংখ্যাটি বলেননি। পরে আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোনো হাসপাতালে ডিউটি করব না।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও কর্মবিরতি পালন করছেন চিকিৎসকরা। তবে এতে হাসপাতালের কার্যক্রমে খুব বেশি প্রভাব পড়ছে না বলে জানিয়েছেন জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. আলা উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকারি রেসিডেন্টরা সবাই আছেন। ফলে কাজ চালাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, কোনো রোগী ফেরত যাচ্ছে না।’
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক কামরুল হাসান বলেছেন, তাদের ওই ইউনিটে ইন্টার্ন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি মিলিয়ে ৯ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মধ্যে দুজন সরকারি চিকিৎসক। কর্মবিরতি চলায় দুজন বাদে বাকিরা আসেননি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেছেন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি এবং ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করায় ওই হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে সমস্যা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘হাসপাতালের মূল ওয়ার্কফোর্স ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তারা ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন। তারা না আসায় মিড লেভেল, লোয়ার লেভেলের চিকিৎসকদের ওপর কাজের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। কিছু কাজ করা যাচ্ছে না।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন গত রোববার বলেছিলেন, তিনি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। আমি তাদের জন্য কী কী উদ্যোগ নেব, তা তাদের বলেছি। অলরেডি কাজ শুরু করছি। তাদের বলেছি আমি মন্ত্রী হয়েছি মাত্র দুই মাস, এক বছর আগে কী হয়েছে তা তো আমি জানি না। আমার কাছে তারা দাবি উঠাইছে, একটু সময় দিতে হবে। আমি এই মুহূর্তে খুব ব্যস্ত, ভুটানের রাজা আসবে। তারপর আমি তাদের বিষয়টি নিয়ে কাজ করব। আমি এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলব।
দেশে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসক প্রায় আট হাজার, ইন্টার্নি চিকিৎসক চার হাজার। এই চিকিৎসকরা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের পরামর্শ ও নির্দেশনায় অস্ত্রোপচারসহ সব ধরনের চিকিৎসা সেবা দেন।
পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনিদের ভাতা ৫০ হাজার টাকা করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন চিকিৎসকরা। গত বছর ওই ভাতার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়। তবে তাতে তারা সন্তুষ্ট নন।
ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ১৫ হাজার টাকা ভাতা পান, তারা সেটি ৩০ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছেন।
তাদের চার দফা দাবির মধ্যে এফসিপিএস, রেসিডেন্ট, ননরেসিডেন্ট চিকিৎসকদের বকেয়া ভাতা পরিশোধ করার বিষয়টিও রয়েছে। এছাড়া বিএসএসএমইউ’র অধীনে ১২টি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্ট এবং নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের ভাতা আবার চালু করা এবং চিকিৎসক সুরক্ষা আইন সংসদে পাস ও বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন তারা।