নিজস্ব প্রতিবেদক: নতুন আয়কর আইনে উৎসে কর কর্তনের বিধানে তেমন পরিবর্তন করা হয়নি। আর উৎসে কর কর্তনের হার নির্ধারণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো রকম সমীক্ষা করেনি। অনেক ক্ষেত্রেই কর কর্তনের হার ব্যবসার প্রকৃত মুনাফার তুলনায় অনেক বেশি। উৎসে করের বিদ্যমান কাঠামোর কারণে ব্যবসায়ীদের কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। সেজন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে উৎসে কর্তনের যৌক্তিক হার নির্ধারণে সমীক্ষা কার্যক্রম নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য আয়কর, মূসক ও শুল্ক খাতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি এফবিসিসিআই’র সভাপতি মাহবুবুল আলম এই চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে আয়কর বিষয়ে বলা হয়েছে, আয়কর থেকে আশানুরূপ রাজস্ব আহরিত হচ্ছে না। আয়কর খাতের সম্প্রসারণ ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীরা এনবিআরের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এছাড়া করযোগ্য সবাইকে আয়কর রিটার্ন দাখিল পরিপালনে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে এফবিসিসিআই সহায়তা করবে। বলা হয়েছে, নতুন আয়কর আইন যুগোপযোগী ও আর্ন্তজাতিক মানের হবে বলে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল। তবে আইনটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে সংশোধনী করা প্রয়োজন। অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল ও আয় নির্ধারণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীরা অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। অনলাইন-সংক্রান্ত কিছু কার্যক্রম প্রবর্তন করা হলেও তা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়নি। এতে কর কর্মকর্তা ও করদাতাদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধির পরিবেশ গড়ে উঠবে।
উৎসে আয়কর বিষয়ে বলা হয়েছে, নতুন আইনে উৎসে কর কর্তনের বিধানের তেমন পরিবর্তন হয়নি। উৎসে কর কর্তনের হার নির্ধারণের জন্য কোনো রকম সমীক্ষা করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই কর কর্তনের হার ব্যবসার প্রকৃত মুনাফার তুলনায় অনেক বেশি। কর কর্তনের যৌক্তিক হার সমীক্ষার জন্য কার্যক্রম নেয়া প্রয়োজন। নতুন আইনে ৩৯টি খাতের উৎসে কর কর্তন ন্যূনতম করের আওতায় আনা হয়েছে। এতে সংশোধনী আনা প্রয়োজন। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকে আয়কর রিটার্ন দাখিলে উদ্বুদ্ধ করা। আইনের ১৮২ ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধানকারী টিম, অডিট টিম, অডিট কিউরেটরসহ সাত কর্র্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অডিট আইন করদাতাদের জন্য চরম হয়রানিমূলক বিধায় ধারাটি বাতিল করে পুরোনো আইনের ৮২ বিবি ধারায় পুনঃপ্রবর্তন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অপরদিকে, চিঠিতে রপ্তানিকে প্রতিযোগী করে তোলার জন্য স্থানীয় বাজার থেকে সংগৃহীত এসব পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দিতে অনুরোধ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ছাপাখানা, কুরিয়ার বা এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্ম, ফেয়ার ট্রেড, জিওটিএ, বিসিআই ইন্সপেকশন ফি, আর্কিটেক্ট ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম, কনসালট্যান্সি চার্জ (দেশি-বিদেশি), কমপ্লায়েন্ট অডিট, প্রশিক্ষণ ফি, আইন পরামর্শক চার্জ, রপ্তানি কাজে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ মেরামত ব্যয় জেনারেট, বয়লার, স্টানটার মেশিন, ড্রাইং মেশিন, সুতা উৎপাদনকারী মেশিন, সিএসআর-সংক্রান্ত খরচ, ভবন নির্মাণ ব্যয় ও রপ্তানির কাজে নিয়োজিত জেনারেটরের জ্বালানি ক্রয়। অপরদিকে আমদানি করা উপকরণে তিন ও পাঁচ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহার করা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে শিল্পের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। উৎসে কর্তন সম্প্রসারণ না করে কর্তনের হার কমিয়ে আনা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সব শপিংমলে ইএফডি স্থাপন, নিবন্ধিত বা তালিকাভুক্ত ব্যক্তির উপকরণ-উৎপাদ সহগ ঘোষণার বিধান বাতিল, ভ্যাটের মাল্টিপুল ভ্যাট রেটকে যৌক্তিক হারে হ্রাস করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া সাব-কন্ট্রাক্টের বিপরীতে ভ্যাট অব্যাহতির শর্ত সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া চিঠিতে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কখনোই জানতে পারেন না, কী কারণে তাদের যৌক্তিক প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়নি।’ ‘আগামী কনসালটেটিভ সভাকে কার্যকর করতে প্রতিটি সভার কার্যবিবরণী করা প্রয়োজন’ বলে জানায় সংগঠনটি। আগামী ৪ এপ্রিল এই সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এফবিসিসিআই সূত্র জানিয়েছে, ওই সভায়ও এ বিষয়গুলো আলোচনায় আসবে। এফবিসিসিআইয়ের ওই চিঠিতে বর্তমানে অর্থনীতিতে অন্তত ১১টি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাজার মনিটরিং, রিজার্ভ সংকট, রেমিট্যান্সে শ্লথ গতি, রপ্তানি বৃদ্ধি ও নতুন বাজার সংযোজন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা, সুদের হার ও ব্যাংক খাতের সংকট, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন, ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও বৃদ্ধি, রেভিনিউ পলিসি রিফর্ম এবং মনিটারি ও ফিসক্যাল পলিসির মধ্যে সমন্বয় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। এ পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরে অন্তত সাতটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। এর মধ্যে রয়েছে নিত্য ব্যবহার্য পণ্যমূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা এবং স্থানীয় শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া।
চিঠিতে বিলাস দ্রব্য, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষায় তালিকাভুক্ত পণ্য ও অনভিপ্রেত পণ্যের ব্যবহার সীমিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করার আহ্বান জানানো হয়। অর্থাৎ এর বাইরে অন্যান্য পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রয়োগ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে এনবিআরের কর্মকর্তাদের দেয়া পুরস্কার বাতিলের দাবিও জানানো হয়।
মানিলন্ডারিং রোধে স্ট্রং পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট প্রয়োজন
এফবিসিসিআই’র চিঠিতে বহুল আলোচিত মানি লন্ডারিং রোধে স্ট্রং পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রসঙ্গত, দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে বলে বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন গত বছর বাজেট প্রস্তাতে জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট নিরসনে বিদেশি ঋণ, সাপ্লায়ারস ক্রেডিট, রেন্টাল স্কিমে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যালোচনা করে পে-ব্যাক ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব কি না, তা পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করা হয়।