সরকারি চাকরিতে প্রতারণা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা

*

সুস্মিতা চক্রবর্তী: কারও কষ্টার্জিত অর্জনের সুফল যখন অন্য কেউ বিনা পরিশ্রমে বছরের পর বছর ভোগ করে তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। এছাড়া তথ্য জালিয়াতি, বিকৃতি ও গোপন করে সরকারি চাকরি করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সরকারি চাকরি করার অনেক আশা থাকে। মা-বাবা ও নিজের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের গল্প প্রত্যেক প্রার্থীর আছে কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়। স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষ নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেন; যার ফলে নির্দোষ প্রার্থীর চাকরি হাতছাড়া হয়ে যায়। শুনতে অবাস্তব হলেও এরকম ঘটনাই অনেক বছর আগে থেকে বাংলাদেশে ঘটছে। আইনের চোখে ধুলো দিয়ে এসব কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনকে হুমকিতে ফেলে।

একজন স্নাতক পাস করা তরুণের ওপর পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য তার মা-বাবাসহ আত্মীয়স্বজন অপেক্ষা করে। এই কঠিন চাকরির বাজারের পরিস্থিতিতে তাকে চাকরির পরীক্ষায়  উত্তীর্ণ হয়ে করে ‘সোনার হরিণ’-এর মতো একটা চাকরি পেতে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একটি চাকরির যোগদানপত্র হাতে পাওয়ায় দিতে পারে এসব পাহাড়সম কষ্ট থেকে মুক্তি। চাকরির পরীক্ষার সব ধাপ যখন একজন চাকরিপ্রার্থী উত্তীর্ণ হয়, তারপর যদি তার চাকরিটির যোগদানপত্র অন্য কেউ পায় এবং তারই নাম, ঠিকানা, বাবার নাম ব্যবহার করে সরকারি চাকরি করতে থাকে, তা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। এছাড়া তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারণা করে চাকরি পাওয়ারও নজির রয়েছে। কিছু মানুষ সরকারি চাকরি করার জন্য নিজের আসল বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা লুকানোর সাথে সাথে একজন কয়েকটি জাতীয় পরিচয়পত্রও বানায়। যথাযথ যাচাইয়ের অভাব, অন্যায়ের কিছু সুযোগ ও লোভী কিছু কর্মচারীর জন্য প্রতারকরা এসব অন্যায় করেও পার পেয়ে যায়। এতে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হয়।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে জানা যায়, সুনামগঞ্জে কারারক্ষীর স্থায়ী পদপ্রার্থী হিসেবে সাখাওয়াত হোসেন কারা অধিদপ্তরে ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সশরীরে উপস্থিত হয়ে কাগজপত্র জমা দেন। শারীরিকভাবে চাকরির জন্য উপযুক্ত হওয়ার পর, লিখিত পরীক্ষার উত্তীর্ণ হওয়ার পরবর্তীতে ভাইভা পরীক্ষায় পাশকারীদের বাড়িতে নিয়োগপত্র চলে যাবে বলে জানানো হয়। ২০০৩-০৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ বছরে সেই চাকরির নিয়োগপত্র না পেলে আশাহত হয়ে তিনি বাদাম ভাজা, আইসক্রিম বিক্রি, মানুষের বাড়িতে কাজ ও টিউশনি করেছেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হয়েও তাকে সরকারি চাকরি না পেয়ে মানুষের বিভিন্ন ধরনের কটুকথাও শুনতে হয়। পরবর্তীতে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি সহকারী শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল সাখাওয়াতের। হঠাৎ ২০১৬ সালে ধর্মপাশা থানা থেকে ফোন আসে তার কাছে। তাকে কারারক্ষী হিসেবে ভেরিফিকেশন করতে বলা হয়। এতে তিনি অবাক হয়ে যান। পরে আরও একবার একই কারণে ফোন আসে। ভেরিফিকেশনের তথ্য থেকে জানা যায়, ধর্মপাশার নওথার গ্রামের মৃত ফয়েজ আলীর ছেলে সাখাওয়াত হোসেন কারারক্ষী হিসেবে যোগদান করেছিলেন আর এখন তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি চাকরিটিতে যোগদান না করলেও জানতে পারেন ২০০৪ সালে তার নামে অন্য কেউ সেই চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ইকরাম হোসেন, যার বাবার নাম ধনু মিয়াÑতিনিই আসল সাখাওয়াত হোসেনের নাম, বাবার নাম, জš§ তারিখ ব্যবহার করে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র জোগাড় করে ১৬ বছর ধরে সরকারি চাকরি করে যাচ্ছেন।

২০০৩ সালে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কারা অধিদপ্তরে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়। কুমিল্লার ৬১ জন সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা না হয়েও ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি করছিলেন। এ জালিয়াতির ঘটনা প্রথম ধরা পড়ে ২০১৫ সালে যখন আব্দুর নূর নামে একজন ব্যক্তি জানতে পারেন তার পরিবর্তে চাকরি করছেন কুমিল্লার ধর্মপুরের বেলায়েত হোসেন। আব্দুর নূরের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট কারা বিভাগ ৩ সদস্যের তদন্ত দল গঠন করে যেখানে সাবেক ডিআইজি, সিনিয়র জেল সুপার, জেলারসহ উচ্চপদস্থ ৫ কর্মকর্তা এই দুর্নীতির নিয়োগে জড়িত দোষী প্রমাণিত হন। তাদের মধ্যে ২ জন মারা গিয়েছেন ও ৩ জন অবসরে আছেন। জালিয়াতিকারী নকল নিয়োগপ্রাপ্ত সবাইকে চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুত বা শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে কি না, তা আজও অজানা।

সংবাদপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো. শহীদুল ইসলাম ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৩৭ বছর বয়সে চাকরিতে যোগদান করেন। সার্ভিস বই ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার বয়স, বাবা ও মায়ের নামের সাদৃশ্য না থাকায় তিনি বিপদে পড়েন। চাকরি বাঁচানোর জন্য তিনি দ্বিতীয়বার ৮ বছর কমিয়ে ঢাকার উত্তরার ভোটার হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র বানান। এতে তিনি বাবা ও মায়ের নামের বানানে ভিন্নতা নিয়ে আসেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে এখনও তার দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র সচল আছে। এভাবেই নিজের বয়স, বাবা, মায়ের নামসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুই শতাধিক সরকারি কর্মচারী চাকরি করছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছেন রেলওয়েতে। তাদের অনেকের দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র বিদ্যমান। এমনকি কেউ কেউ আসল শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ না করে তার নিম্নস্তরের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন।

কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ প্রার্থীরা চাকরি পেয়ে থাকে। কারও যদি সরকারি চাকরি পেতে হয় তাহলে পরিশ্রমও কিছুটা বেশি করতে হয়। এত পরিশ্রম, ত্যাগ ও ধৈর্যের ফলে বহুল আকাক্সিক্ষত চাকরি পাওয়ার আশায় প্রত্যেক ছেলেমেয়ে নিজের ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে। বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মিলবে সরকারি চাকরিÑএ আশায় চাকরিপ্রার্থী ও তার পরিবারের লোকেরা বুক বাঁধেন। দুঃখের বিষয় হলো, এই আশার গুড়েবালি হয় যখন কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অযোগ্য প্রার্থীকে চাকরিতে যোগদানের সুযোগ করে দেন। আবার কিছু সরকারি চাকরিপ্রার্থীদেরও প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে সহজে অন্য যোগ্য প্রার্থীর প্রাপ্য চাকরি নিজের করে নেয়ার প্রবণতা আছে। এজন্য তারা তথ্য গোপন, জালিয়াতি, বিকৃতি, কয়েকবার জাতীয় পরিচয়পত্র বানানো, ঘুষ দেয়া ইত্যাদি পথ অবলম্বন করে থাকে।

পরিবার থেকেই মানুষ প্রথম শিক্ষা পায়। সে জন্য পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও সততা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনের পথ প্রদর্শন করার শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। ফলে অন্যায় করার প্রবৃত্তি কারও হবে না। অনৈতিক ও বেআইনি কাজকর্ম থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি ও তথ্যের অধিকতর যাচাই-বাছাই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এর জন্য যদি নতুন আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করার প্রয়োজন হয় তাহলে তাই করতে হবে। সৎ, মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীর মেধার মূল্যায়নের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা আবশ্যক। অন্যথায় তারা যেই পর্যায়েই যাক না কেন দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়াতে থাকলে। এ কারণে জালিয়াতি হওয়ার সকল প্রকার রাস্তা বন্ধ করে এটিকে সমূলে উৎখাত করতে হবে। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে দ্রুততার সাথে বিচারকাজ করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে প্রতারণা ও দুর্নীতি কমবে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০