চবির সাবেক উপাচার্য শিরীণের যত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড

 

মো. শামীম হোসাইন, চবি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ১৮তম ও প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের মেয়াদ গত মার্চ মাসের ১৯ তারিখে শেষ হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ও চবির ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের ১৯তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। তার চার বছরের মেয়াদকাল নানা কারণেই আলোচিত ও সমালোচিত, যেজন্য অধ্যাপক শিরীণ হয়েছেন খবরের শিরোনামের মধ্যমণি।

নানা অনিয়ম কখনও বেফাঁস মন্তব্য, কখনও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা কাছের মানুষদের মাঝে পদ বণ্টন এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগে জর্জর ছিলেন তার মেয়াদকাল।

আইন বিভাগ ও বাংলা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম: শিরীণের মেয়াদের শেষ দিকে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বাংলা ও আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ চেষ্টায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি এবং তার প্রশাসন। পরবর্তী সময়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেণু কুমার দের পদত্যাগের দাবিতে অর্ধশতাধিক শিক্ষক লাগাতার এক মাস আন্দোলন করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবনের সামনে।

বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত: বাংলা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন শিক্ষক সমিতির তোপের মুখে এবং চার সদস্যবিশিষ্ট বাংলা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ডে বাংলা বিভাগের দুই সদস্য অধ্যাপক ড. তাসলিমা বেগম (সভাপতি, চবি বাংলা বিভাগ) এবং অধ্যাপক ড. মহীবুল আজিজ (সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চবি) নির্বাচনী বোর্ড সভায় বসতে অস্বীকৃতি জানালে বিতর্কিত এই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়।

পালি বিভাগে বিধিবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা: বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাতিলযোগ্য, মিথ্যা তথ্যসংবলিত, অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ দরখাস্তের পরও নিজের আস্থাভাজন সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়াকে নিয়োগদানের চেষ্টায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে বাধ্য হয়ে তাকে নিয়োগদানে বিরত থাকতে হয়।

ফারসি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে অর্থ লেনদেনের অডিও ফাঁস: ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে টাকা লেনদেনের অডিও ফাঁসের ঘটনায় নিয়োগ বোর্ড বাতিল করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেটের ৫৩৭তম সভায় ফারসি বিভাগের নিয়োগ বাতিল করা হয়। সিন্ডিকেট সভার পর সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য শিরীণ আখতার নিজেই এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। ওই কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, তৃতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য দিতে হবে ১০ হতে ১২ লাখ টাকা, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে লাগবে ৮ লাখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হতে প্রয়োজন ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা। আর শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মানের পদ তাই ১৬ লাখের কমে হবে না।

একযোগে ১৮ পদ থেকে ১৬ জনের পদত্যাগ:  উপাচার্যের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে ২০২৩ সালের ১৩ মার্চ প্রক্টরসহ একযোগে ১৮ পদ থেকে ১৬ জনের পদত্যাগ ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে ছিল। যেখানে ১৮ পদের মধ্যে একটি প্রক্টরের, পাঁচটি সহকারী প্রক্টরের, ১১টি বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ ও হাউজ টিউটর পদ ও একটি আইকিএসির অতিরিক্ত পরিচালক পদ ছিল।

সাংবাদিক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ কর্মীদের মানবিক কারণে ক্ষমা: চবি সাংবাদিক সমিতির সদস্য দোস্ত মোহাম্মদের ওপর হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে অনেকটা বাধ্য হয়েই ৬ মাসের সাময়িক বহিষ্কার আদেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে মানবিক কারণ দেখিয়ে ৪ মাস না যেতেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেন অধ্যাপক শিরীণ আখতার।

এক সেমিনারেই খরচ ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মিলনায়তনে ২০২৩ সালের ৪ জুন ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। উপাচার্য শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এতে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ দেখিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল অধ্যাপক শিরীণের প্রশাসন।

এক ভবন উদ্বোধনেই সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা খরচ দেখিয়ে সমালোচিত:  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের একাডেমিক ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা খরচ দেখিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নির্ভরযোগ্য সংস্থা দিয়ে এর তদন্তের দাবিও উঠেছিল তখন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ব্যয়ের সঠিক হিসাব জানতে চেয়ে উপাচার্য শিরীণ আখতার বরাবর চিঠি পর্যন্ত পাঠায়।

দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চবি উপাচার্যের বিজ্ঞাপন: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও  শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন অধ্যাপক শিরীণ আখতার। এই বিজ্ঞাপনের ব্যয় কোন খাত থেকে নির্বাহ করা হবে তা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। পরবর্তীতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বিজ্ঞাপনের ব্যয় নিজেকেই বহন করতে হয় অধ্যাপক শিরীণের।

ইউজিসির আদেশ উপেক্ষা: দৈনিক মজুরি কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ রাখতে ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয় ইউজিসি। তবে এ নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে একের পর এক দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যাপক শিরীণ। গত তিন মাসে অন্তত ১০৫ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। গত ৩ জানুয়ারিও উপাচার্যকে চিঠি পাটিয়ে ইউজিসি বাংলা ও আইন বিভাগে অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ স্থগিত করতে বলে। সে প্রক্রিয়া স্থগিত করলেও দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ বহাল রাখেন তিনি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে উপাচার্যের সহকারীর ফোনালাপ ফাঁসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগের অনুমোদন আটকে দিয়েছিল ইউজিসি। এর পর ওই বছরের ১৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসিতে প্রতিবেদন পাঠায়। ওই চিঠিতে তদন্তের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু সাবেক উপাচার্য তা পাত্তা দেননি।

ছাত্রলীগ শাসাল রেজিস্ট্রারকে: রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদকে অফিস কক্ষেই শাসালেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগের এক কর্মী তার সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন ভিডিওতে দেখা যায়, শাখা ছাত্রলীগের বিজয় গ্রুপের একাংশের কর্মী ওয়াহিদুল ইসলাম রেজিস্ট্রার নুর আহমদের দিকে তেড়ে যান। এ সময় আঙুল উঁচিয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘ছাত্রলীগ কর্মীদের বাইরে সব নিয়োগ ক্যান্সেল করতে হবে। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, টেবিল চাপড়িয়ে একই কথা বলছেন একই গ্রুপের নেতা শাখা ছাত্রলীগের সাবেক আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোরশেদুল আলম রিফাত। তিনি রেজিস্ট্রারের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘ছাত্রলীগের পোলারে নিয়োগ দিলে সমস্যা নেই। ছাত্রলীগের বাইরে যেগুলা, ওইগুলা ক্যান্সেল

শেষ কর্মদিবসে ৩ ডজনেরও বেশি নিয়োগ: শেষ কর্মদিবসে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ৩ ডজনেরও বেশি মানুষকে চাকরি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এরা সবাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। অস্থায়ী ভিত্তিতে এদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিনি উপাচার্য থাকাকালে দীর্ঘ সাড়ে চার বছরেরও বেশি মেয়াদকালে প্রায় সাড়ে ৫০০ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছেন বলে জানা যায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০