কবিয়াল রমেশ শীলের মৃত্যুদিবস আজ। ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার গোমদন্ডী গ্রামে তার জন্ম। আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতা ও শহরতলিতে কবিগান ও কবিয়ালদের উদ্ভব হয়। উনিশ-বিশ শতকে চট্টগ্রামের রমেশ শীল, বরিশালের মুকুন্দদাস এবং মুর্শিদাবাদের শেখ গুমানী ছিলেন তাদের উত্তরসূরি। তারা প্রত্যেকেই স্বভাবকবি ছিলেন; গানের আসরে তারা তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করে গাইতেন।
কবিয়াল হিসেবে রমেশ শীলের খ্যাতি আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তার জীবৎকালে সংঘটিত অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সূর্যসেনের আত্মাহুতি, দুর্ভিক্ষ, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, ভাষা আন্দোলন, সামাজিক অবিচার, দুর্নীতি, মহাজনি শোষণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি গান বেঁধেছেন এবং সেসব গেয়ে জনগণের মনে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করেছেন। পূর্বে কবিগান ছিল কেবল চিত্তবিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু রমেশ শীল একে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারে পরিণত করেন। এরূপ সংগ্রামী ভূমিকার কারণে তিনি ১৯৫৪ সালে কারাবরণ করেন এবং ১৯৬২ সালে সরকার কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত মাসোহারা হারান। লঘু বিষয় ও কুরুচির পরিবর্তে গুরু বিষয় ও সুরুচির আমদানি করে তিনি কবিগানের গুণগত পরিবর্তন সাধন করেন। এটিও তার এক বিশেষ কৃতিত্ব। রমেশ শীলের অপর কৃতিত্ব মাইজভান্ডারি গান রচনা ও তা গেয়ে জনপ্রিয় করে তোলা। চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি তরিকার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদুল্লাহর (১৮২৬-১৯০৬) গুণকীর্তন এবং এ ধারার আধ্যাত্মিক মহিমা তুলে ধরে তিনি বহু গান রচনা করেন। তার এ-জাতীয় গানের সংখ্যা প্রায় ৩৫০। গানগুলো বিভিন্ন সময়ে আশেকমালা, শান্তিভান্ডার, মুক্তির দরবার, নূরে দুনিয়া, জীবনসাথী, সত্যদর্পণ, ভাণ্ডারে মওলা, মানববন্ধু ও এস্কে সিরাজিয়া এই ৯টি পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। মাইজভান্ডারির গদিনশিন পীর সৈয়দ গোলামুর রহমান (১৮৬৫-১৯৩৭) তার সমসাময়িক ছিলেন। রমেশ শীল এ তরিকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং আন্তঃপ্রেরণাবশে এ ধারার সাধনসংগীত রচনা করেন। রমেশ শীলের গানের গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। তার রচিত ‘চলরে মন ত্বরাই যাই, বিলম্বের আর সময় নাই/ গাউছুল আজম মাইজভান্ডারি স্কুল খুলেছে’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। পুত্র যজ্ঞেশ্বর শীলও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এছাড়া ফণী বড়ুয়া, রাইগোপাল দাস প্রমুখের মতো যোগ্য শিষ্যও তিনি রেখে গেছেন। সম্প্রতি বাংলা একাডেমি তার সমগ্র রচনাবলি প্রকাশ করেছে। ১৯৬২ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি রমেশ শীলকে শ্রেষ্ঠ লোককবির সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [সংগৃহীত]