২০২৪ সালে অর্থনীতির সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জসমূহ

 

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অগ্রগতি প্রদর্শন করেছে। স্বাধীনতার চার দশকের মধ্যে দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে দেশটির যাত্রা তার স্থিতিস্থাপকতা, নীতিগত সিদ্ধান্ত, দারিদ্র্য হ্রাস এবং সমৃদ্ধির লালনপালনের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ দেয়। বিশ্বব্যাংক তার সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘ডড়ৎষফ ইধহশ রহ ইধহমষধফবংয রহ ২০২৪’-এ একথা বলেছে।

নিম্নস্তরের মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চস্তরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি এবং আর্থ-সামাজিক সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের স্থিতিতে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্নাতক হওয়ার পথে এবং ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।

যাহোক, ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রাধিকার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে। যদিও ইইউ ও যুক্তরাজ্য অতিরিক্ত তিন বছরের জন্য অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক-মুক্ত বাজার অ্যাকসেস বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, তবে অন্যান্য বাজারে রপ্তানির পরিস্থিতি গ্র্যাজুয়েশনের পরপরই পরিবর্তিত হবে। ৩ দশমিক ০৮ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপিএবং ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্যসহ ৬৬১ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে গঠিত আসিয়ান অঞ্চলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ  আসিয়ান দেশগুলো থেকে প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে, যেখানে রপ্তানি করে মাত্র ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। তাই বাংলাদেশের রপ্তানি বাডাতে আসিয়ানের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

বিভিন্ন বড় মেগাপ্রকল্প, যেমন পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজারের রেলওয়ে সংযোগ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালÑএগুলো অধিকাংশ শেষ হয়েছে এবং ২০২৪ সালে এর সুফল পাওয়া শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যাহোক, ২০২৪ সালে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, বাজেটের ঘাটতিসহ পরিশোধের ভারসাম্য ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, রেমিট্যান্স সংকোচন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য এবং এনার্জি খাতে চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, ঋণখেলাপি দ্বারা পঙ্গু দুর্বল ব্যাংক খাত প্রভৃতির মতো একাধিক ক্ষেত্রে অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলেও অধিকাংশ দেশে তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধির হার সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার রপ্তানি ঝুড়ির বৈচিত্র্যকরণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি পোশাক রপ্তানি থেকে আসে। চামড়া ও পাদুকা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ফার্মাসিউটিক্যালস, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্টস এবং এপিআই উৎপাদনে বাংলাদেশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ খাতগুলোয় অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ এবং এফডিআই উভয়ই বাড়াতে হবে।

অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রবর্তন এবং অন্যান্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও এফডিআই আকর্ষণে বাংলাদেশ মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এফডিআই আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পর ভিয়েতনাম চতুর্থ স্থানে রয়েছে। ভিয়েতনামে ২০২২ সালের শেষে ২৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মোট ঋণপ্রবাহের সিংহভাগই ছিল উৎপাদন খাতে, যা মোট নিবন্ধিত ঋণের ৬১ শতাংশ। ভিয়েতনামের ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশ বার্ষিক গড়ে ২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার এফডিআই পেয়েছে। এফডিআই হলো রপ্তানি আয় বাড়ানো এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিও অন্যতম প্রধান উপাদান। বাংলাদেশের উচিতএফডিআই আকর্ষণের জন্য ভিয়েতনামের কৌশল পর্যালোচনা করা।

আমদানিকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বছরে প্রায় আনুমানিক ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হচ্ছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য ও ক্লিনটেক বিকল্পের অভাব রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস অনুসন্ধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, তেল ও এলএনজি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জার্মানওয়াচের ২০২১ গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুসারে, ২০০০-২০১৯ সময়কালে জলবায়ু বিপর্যয়ের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে।

অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশ আজকের অবস্থান অর্জন করেছে। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে লক্ষ্যমাত্রামূলক পদক্ষেপ এবং যথাযথ নীতি অনুসরণ করে সময়োপযোগী বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যমআয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা রাখে।

 

আইসিসিবির ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০