ধরিত্রী রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিই ভরসা

সাধন সরকার: জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান বাস্তবতায় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ কমানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার। নবায়নযোগ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বর্জ্য থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর অন্যান্য পার্শ্ববর্তী দেশ যে গতিতে নবায়নযোগ্য শক্তিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ তাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে! সোলার প্যানেলের দাম ও খরচ বেশি, আবার সক্ষমতাও কম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই ব্যবস্থাপনার দিকে ঝুঁকছে। কারণ এতে পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয় না। গ্যাস দিন দিন ফুরিয়ে আসছে! দেশের উন্নতি করতে হলে শিল্পকলকারখানা লাগবে। যার ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এছাড়া আবার দেখা দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক রূপ। প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় জ্বালানি হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকেই গুরুত্ব দিতেই হবে। পরিবেশগত বিপর্যয়, টেকসই উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নে নবায়নযোগ্য সবুজ জ্বালানির বিকল্প নেই।

নবায়নযোগ্য শক্তি হলো যা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এবং এর শক্তির উৎস নিঃশেষ হয়ে যায় না। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান প্রাকৃতিক উৎস হলো সূর্যের তাপ ও আলো, বায়ু, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি (বায়োগ্যাস, বায়োম্যাস ও বায়োফুয়েল) ইত্যাদি। এছাড়া অন্যান্য আরও কিছু নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হলো ভূতাপ, সমুদ্রতরঙ্গ, সমুদ্রতাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ও নিউক্লিয়ার শক্তি ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উন্নত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার ওপর একটি দেশের উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বে নিত্য নতুন উদ্ভাবন থেমে নেই। যে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যত উন্নত সে দেশ তত উন্নত। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তি। প্রধান নবায়নযোগ্য শক্তিগুলোর মধ্যে প্রথমেই চলে আসে সৌরশক্তির কথা। সৌরশক্তি হচ্ছে সূর্যরশ্মিকে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিণত করা। আংশিক পরিবাহী উপকরণ সাধারণত সিলিকন নির্মিত সৌর কোষগুলোর প্যানেল ব্যবহার করে সৌরশক্তি ধরে রাখা হয়। সৌরশক্তি উৎপাদন একটি সাশ্রয়ী, সহজ ও পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া। দেশে এ পর্যন্ত স্থাপিত সোলার সিস্টেমের বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে প্রায় ১৩ লাখেরও বেশি মানুষ। দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার খুবই কম। সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছিল। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যা মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের সাড়ে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে জ্বালানি রূপান্তরের মাধ্যমে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য সম্পদ জ্বালানি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদ খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে।

ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পও লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছায়নি। বর্তমানে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৬৫ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো গেলে তা সার্বিক পরিবেশের জন্যও ভালো হবে। বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। গৃহস্থালিতে পরিত্যক্ত বিভিন্ন পচনশীল বর্জ্য, কৃষিজ ফসলের অবশিষ্টাংশ, গোবর ও অন্যান্য প্রাণীর মলমূত্র বাতাসের অনুপস্থিতিতে গাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়োগ্যাস তৈরি করা হয়। এর প্রধান উপাদান হলো মিথেন। মিথেন-সংবলিত এই বায়োগ্যাসের বাকি অবশিষ্টাংশ জমিতে উন্নতমানের জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পরিবেশও ভালো থাকবে এবং বিদ্যুতের চাহিদাও মিটবে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী। জলের প্রবাহ বা স্রোতকে কাজে লাগিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটি রয়েছে কর্ণফুলী নদীতে স্থাপিত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখানে ২০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সাধারণত খরস্রোতা নদীতে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উপাদন করা হয়। আমাদের খরস্রোতা নদীগুলোতে এ ব্যবস্থা কাজে লাগাতে পারলে নদী-তীরবর্তী এলাকার মানুষ সহজেই বিদ্যুৎ পাবে। পরিবেশের অন্যতম উপাদান হলো বাতাস। এক্ষেত্রে টারবাইন ঘুরিয়ে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বিশ্বে বায়ু বিদ্যুৎ প্লান্টের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মূলত এক্ষেত্রে নদী তীরবর্তী এলাকার গতিশীল বাতাসকে কাজে লাগানো হয়। বিশ্লেষকরা এক্ষেত্রে মেঘনা নদীর তীরে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন। অন্যান্য নদীর তীরবর্তী এলাকায়ও এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যেতে পারে। আমাদের প্রায় ৭শ কিলোমিটার উপকূলবর্তী সীমানাবেষ্টিত এলাকাকে এ ব্যবস্থাপনায় আনা যেতে পারে।

আমাদের দেশে বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন প্রশংসার যোগ্য হলেও বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ তথা ২৫ ভাগ বিদ্যুৎ যদি নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে পাওয়া যায় তাহলেও একটা দেশের জন্য যথেষ্ট। জ্বীবাশ্মর কার্বন নিঃসরণ থেকে মুক্তি পেতে ও  জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে কাজে লাগাতে হবে।

 

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০