রোহান রাজিব : ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। দৈনন্দিন লেনদেন মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করছে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংক। গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করা অর্থের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। আর মঙ্গলবার এক নিলামে ৩২টি ব্যাংক ও চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রেপো ও তারল্য সহায়তা সুবিধার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ১৩ হাজার ২০ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। রেপোতে এভাবে নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল।
সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ কর্মসূচি চলমান। দুই কিস্তির অর্থও পেয়েছে। দুই মাসের মধ্যে তৃতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা। তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে গত মঙ্গলবার আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল ২ সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ সফরে এসেছে। এই প্রতিনিধিদল ঋণের শর্তের অগ্রগতিসহ অর্থনৈতিক অবস্থা মূল্যায়ন করবে। এরপর ঋণের তৃতীয় কিস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে সংস্থাটি।
সফরসূচির প্রথম দিন গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন প্রতিনিধিদল। বৈঠকে মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি, বিদেশি বাণিজ্যের ভারসাম্য ও আউটলুক, মুদ্রা বাজার, তারল্য ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাত সংস্কার, খেলাপি ঋণ ও সুদের হার বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এ সময় আইএমএফের প্রতিনিধিদল খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর আওতায় ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন ধার দেয়ার পদ্ধতি এখনও বন্ধ না করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দাতা সংস্থাটি। এছাড়া অপ্রত্যাশিত রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে আনার ওপর জোর দিয়েছে আইএমএফ।
সূত্র জানায়, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে মিলিত করেন আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। সর্বশেষ বেলা সাড়ে ৩টা থেকে পৌনে ৫টায় বৈঠক হয় বিআরপিডি, অফসাইট ও এফএসডি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এতে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার।
বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চান দাতা সংস্থাটির সদস্যরা। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানানো হয়, ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি পথনকশা ঘোষণা করা হয়। এতে খেলাপি ঋণ কমানোসহ মোট ১৭টি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য মন্দঋণ অবলোপন করার সময় এক বছর কমিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে দুই বছর মন্দ মানে শ্রেণিকৃত যেকোনো ঋণই অবলোপন করা যাবে।
আগে তিন বছর মন্দ মানের খেলাপি থাকার পর তবেই ওই ঋণ অবলোপন করার সুযোগ ছিল। এ বিষয়ে গত ১৯ ফেব্রয়ারি সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংক খাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমবে।
অন্যদিকে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে খেলাপি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে কোনো মেয়াদি ঋণের কিস্তি বা এর অংশবিশেষ পরিশোধের নির্ধারিত তারিখের পর থেকে ছয় মাস পর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এসব ঋণের কিস্তি বা কিস্তির অংশবিশেষ পরিশোধের নির্ধারিত দিন থেকে পরবর্তী ৩ মাস পর মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। এক্ষেত্রে সময় কমানো হয়েছে ৩ মাস। আগামী বছরের ৩১ মার্চ থেকে তা পরিশোধের নির্ধারিত দিনের পরদিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। এক্ষেত্রে কোনো সময় দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে গত ৮ এপ্রিল সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে আইএমএফ খুবই খুশি। কারণ বিআরপিডি রিলেটেড আইএমএফের যেসব চাওয়া ছিল, সেটা ইতোমধ্যে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এর আগে বেলা ২টা থেকে সোয়া ৩টা পর্যন্ত মুদ্রানীতি, গবেষণা এবং ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সঙ্গে আইএমএফ বৈঠক করে। এতে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. খুরশিদ আলম।
বৈঠকে মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চায় আইএমএফ। বিশেষ করে রেপোর আওতায় প্রতিদিন ব্যাংকগুলোকে এখনও কেন ধার দেয়া হয়, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা। এ সময় প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়, আগামী জুলাই থেকে প্রতিদিন রেপোতে ধার দেয়ার পদ্ধতি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো সপ্তাহের যে কোনো একদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারবে। আর সেটা অবশ্যই সাত দিন মেয়াদি রেপো ব্যবস্থায়। এ সময় ডলার ও টাকার রেট নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়।
ক্রলিং পেগ পদ্ধতির বাস্তবায়ন কীভাবে কোনো প্রক্রিয়ায় করা হবে সেটা জানতে চায় আইএমএফ। তার আগে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গবেষণা, পরিসংখ্যান, মুদ্রানীতি ও এফআরটিএমডির সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ। এটি ডেপুটি গভর্নর মো. খুরশিদ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে অপ্রত্যাশিত রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে আনার ওপর জোর দেয় দাতা সংস্থাটি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ঋণ দেয়ার শর্ত হিসেবে যেগুলো করতে বলেছিল, সেগুলো কতটা করতে পেরেছি, কোনগুলো করি নাই, যেগুলো করি না সেগুলো কবে করব ইত্যাদি বিষয় জানতে চেয়েছে। আগামী কয়েকদিন এসব বিষয় নিয়ে তারা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবে। এরপর দেশে ফিরে রিপোর্ট করবে। ওই রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়। তবে আমরা তৃতীয় কিস্তি পেতে আশাবাদী।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সাড়ে তিন বছরের মেয়াদে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। ওই ঋণ কার্যক্রমের বিপরীতে অনেক শর্ত দেয়া হয়। রিজার্ভ ছাড়া প্রায় সব শর্ত পূরণ করে দুই দফায় দুই কিস্তির অর্থ পেয়েছেও বাংলাদেশ। এবার তৃতীয় কিস্তির পালা, যা আগামী জুনে পাওয়ার কথা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের শর্ত কতখানি কী পূরণ হলো, তার মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই কিস্তি ছাড় করা হবে। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইএমএফের প্রথম কিস্তি পায় বাংলাদেশ। আর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পায় গত ডিসেম্বরে।
দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার আগে সময়ভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিশেষ করে গত জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তবে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমাতে আইএমএফের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অব্যাহতি চেয়েছিল বাংলাদেশ, সংস্থাটি তা অনুমোদন করে। সে অনুযায়ী ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়।
গত ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারÑকমিয়ে তা ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার করা হয়। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের মার্চ মাসেও নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। মার্চ শেষে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও গতকালের বৈঠকে রিজার্ভ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে।