আনোয়ারুল ইসলাম: সাম্প্রতিক সময়ে চলমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিশ্বের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস কর্তৃক ইসরাইলে মিসাইল হামলার মাধ্যমে ইসরাইল-হামাসের মধ্যকার যুদ্ধ শুরু হয়, যা এখনও চলমান। চলমান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইরান-ইসরাইল প্রত্যক্ষ যুদ্ধ, যার সূত্রপাত হয় ইসরাইল কর্তৃক গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাসের কমপ্লেক্সে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে। ইসরাইলের ওই বিমান হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভুলেশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) আট কর্মকর্তা ও বেসামরিক নাগরিকসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়, যার প্রতিশোধ হিসেবে ১৩ এপ্রিল ইসরাইলে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে তেহরান পাল্টা হামলা চালায়। চলমান যুদ্ধগুলোর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ইউরেশিয়ার কেন্দ্রে ও হরমুজ প্রণালীর কাছে মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হলো ইরান। ইরান নামটি দিয়েছেন একসময় এই অঞ্চলে বসবাসরত আর্য জনগোষ্ঠী। গ্রিকরা এই অঞ্চলকে পার্সিস বলে চিহ্নিত করে, যা ইউরোপীয় ভাষায় পার্সিয়া ও বাংলা ভাষায় পারস্য। ১৯৩৫ সালে দেশটির অফিশিয়াল নামকরণ করা হয় ইরান। দেশটির দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর রয়েছে, যা জ্বালানি রপ্তানির অন্যতম যোগাযোগ পথ। আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরাকের সীমান্ত রয়েছে দেশটির। পারস্য উপসাগরের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের মতো ইরানেও ২০ শতকে শুরু থেকে তেল রপ্তানি অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরানকে শাহ কিংবা রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে পাশ্চাত্যপন্থি দেশ থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইরান। এ বিপ্লবকে বলা হয় ফরাসি ও বলশেভিক বিপ্লবের পর ইতিহাসের তৃতীয় মহান বিপ্লব।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দেশটির ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে সর্বদা তৎপর দেশটি। ওই অঞ্চলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশটির অন্যতম প্রতিপক্ষ হলো সৌদি আরব। আধিপত্য বজায় রাখতে বহু বছর ধরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ইরান-সৌদি। ভূ-রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছাড়াও দেশ দুটির মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। ইসলাম ধর্মের মূল দুটি শাখা যথাক্রমে শিয়া ও সুন্নির অনুসারী ইরান ও সৌদি আরব। মতাদর্শগত বিরোধ রাষ্ট্র দুটিকে বারবার সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। আরব বসন্তের পর ইরান সৌদি আরবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি ও ইরাকের শিয়াপন্থি সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। অপরদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে রয়েছে বাহরাইন, মিসর, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো সুন্নি দেশগুলো।
ইরানের আধিপত্য ইরাকেও লক্ষণীয়। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক হামলা পরিচালিত হলে ইরাকে শিয়াবিরোধী নেতা সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতাচ্যুত হন। মূলত সাদ্দাম হোসেন সরকারের পতনের পর থেকেই ইরাকে ইরানের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইরাকে প্রতিষ্ঠিত হয় শিয়া-সমর্থক সরকার, যা বর্তমানেও পরিলক্ষিত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। মূলত পশ্চিমা দেশগুলো তাদের ভারী শিল্পকারখানা, সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অন্যতম প্রতিপক্ষ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ইরান চারটি বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে, যার মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিহত করা, আঞ্চলিক প্রাধান্য বজায় রাখা, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে জোটবদ্ধতা শক্তিশালী করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্যানসার ক্ষেত্র ইসরাইল ধ্বংস করা। শত্রুতাবশত যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলাকালে পারস্য উপসাগরের ইরানি উপকূল সমুদ্রসীমায় ঢুকে ‘ভিনসেন্স’ নামক মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইরানের বিমানে হামলা চালায়, যাতে প্রায় ২৯০ আরোহী নিহত হন। এছাড়া ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে ইরাকের মাটিতে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে বাগদাদে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রতিহত করতে তাদের প্রতিপক্ষ চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে ইরান। এরই মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক সংবলিত একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী বিদ্যমান, যাদের পশ্চিমারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইয়েমেনের হুতিরা। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রযুক্তি দিয়ে বড় ধরনের সাহায্য সমর্থন দিচ্ছে। যদিও ইরান তা বরাবরের মতোই অস্বীকার করছে। লেবাননে ইরানের মিত্র শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের হামাসকে ইরান অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইরান তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের দা-কুমড়ো সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত হয়েছে ইরান-ইসরায়েল প্রক্সি যুদ্ধ, যা ইরান-ইসরায়েল কোল্ড ওয়ার নামেও পরিচিত। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চলমান প্রক্সি দ্বন্দ্ব বর্তমানে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। ইসরায়েল-লেবানিজ সংঘর্ষে ইরান লেবাননের শিয়া মিলিশিয়াদের সমর্থন করেছে, বিশেষ করে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতে ইরান হামাসের মতো ফিলিস্তিনি দলগুলোকে সমর্থন দিয়েছে। ইসরায়েল ইরানি বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছে। যেমন ইরানের পিপলস মুজাহেদিন, সিরিয়ায় ইরানের মিত্রদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়েছে এবং ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। ২০১৮ সালে ইসরায়েলি বাহিনী সরাসরি সিরিয়ায় ইরানি বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল। ইরানি ইসলামপন্থিরা দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করে আসছে, যাদের তারা নির্যাতিত বলে মনে করে। ইসরায়েল ইরানকে একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে।
সামরিক শক্তিতেও বিশ্বের ইরানের অবস্থান শক্তিশালী গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের (জিএসপি) র্যাংকিং অনুযায়ী বিশ্বে সামরিক শক্তিতে ইরানের অবস্থান ১৪তম। দেশটির রিজার্ভ সেনা রয়েছে প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার, সক্রিয় সেনা রয়েছে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার, ফাইটার এয়ারক্রাফট রয়েছে ১৯৬টি, হেলিকপ্টার রয়েছে ১২৫টি, ট্যাংক রয়েছে চার হাজার সাতটি, সাবমেরিন রয়েছে ১৯ থেকে ২৪টি, ফ্রিগেড রয়েছে পাঁচটি এবং একটি মাইন রয়েছে। তাছাড়া পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে অস্ত্র তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। ইরানের ড্রোন অস্ত্রের সুখ্যাতি রয়েছে।
সম্প্রতি ইরান উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সফলতা অর্জন করেছে, যার মধ্যে অন্যতম সৌদি-ইরান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল বন্দি বিনিময়, ব্রিকসের সদস্যপদ অর্জন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সহায়তা গভীর করা।
মধ্যপ্রাচ্যের অঞ্চলটিতে বিদ্যমান রাজনীতিকে স্থিতিশীল করতে অন্যতম সহায়ক হতে পারে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ রোধ করতে দেশটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়